১৯৭১

রণদাপ্রসাদকে সন্তানসহ তুলে নিয়ে যায় ওরা

Looks like you've blocked notifications!

ভারত উপমহাদেশে যেসব মনীষী আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম রণদাপ্রসাদ সাহা। ব্রিটিশ-ভারতে স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী শহীদ, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত অগণিত রাজনৈতিক কর্মীকে আজও আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। রণদাপ্রসাদ সাহা প্রথম যৌবনে ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে গিয়ে জেল খাটেন। সমাজ বদলের তাড়না থেকে সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী ছিল তার কাম্য।

রণদাপ্রসাদ সাহা ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকা জেলার উপকণ্ঠ সাভারের কাছুর গ্রামে মাতুলালয়ে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ সাহা পোদ্দার এবং মাতার নাম কুমুদিনী দেবী। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল টাঙ্গাইল জেলার মীর্জাপুরে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত তিনি মীর্জাপুর বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তার পিতা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন। তার বয়স যখন সাত বছর, তখন তার মাতা সন্তান প্রসবকালে ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর পিতা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। বিমাতার আশ্রয়ে বহু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ও অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে রণদার শৈশবকাল অতিবাহিত হয়।

চৌদ্দ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা চলে যান রণদা। সেখানে গিয়ে জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে মুটের কাজসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হন। এরই মধ্যে স্বদেশি আন্দোলনে যোগদান করে কয়েকবার কারাবরণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সময় বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে যোগ দিয়ে মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক) যান। সেখানে তিনি হাসপাতালে এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রোগীদের জীবন বাঁচালে তাঁকে নবপ্রতিষ্ঠিত (১৯১৬) বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন প্রদান করা হয়। যুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৯ সালে পঞ্চম জর্জের সঙ্গে সাক্ষাতের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড সফর করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে রেলওয়ে বিভাগে টিকেট কালেক্টরের চাকরি নেন। পরে ১৯৩২ সালে চাকরিতে ইস্তফা দেন তিনি। উপার্জিত ও সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। চার বছরে ব্যবসায়িক সাফল্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এ সময়ে দ্য বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি নামে নৌপরিবহন সংস্থা এবং নৌপরিবহন বিমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৪২-৪৩ সালে সরকারের খাদ্যশস্য ক্রয়ের প্রতিনিধি নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৪৪ সালে নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায় নামেন এবং জর্জ এন্ডারসনের কাছ থেকে 'জুট প্রেসিং বিজনেস' এবং 'গোডাউন ফর জুট স্টোরিং' ক্রয় করে নেন। এর পরে নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় ইংরেজদের মালিকানাধীন তিনটি পাওয়ার হাউস ক্রয় করেন। চামড়ার ব্যবসাও শুরু করেন এ সময়।

কয়লা, চামড়া, পাটের ব্যবসায় নিজ মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ধনকুবেরে পরিণত হন রণদা। পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন ও মানবতার কল্যাণে প্রচুর অর্থ দান করতে থাকেন তিনি। রণদাপ্রসাদ সাহা ১৯৩৮ সালে মীর্জাপুরে ২০ শয্যাবিশিষ্ট 'কুমুদিনী ডিস্পেনসারি' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৪ সালে সেটিই কুমুদিনী হাসপাতাল নামে পূর্ণতা লাভ করে। ১৯৪২ সালে তাঁর প্রপিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামে 'ভারতেশ্বরী বিদ্যাপীঠ' স্থাপন করে ওই অঞ্চলে নারীশিক্ষার সুযোগ করে দেন, যা পরে ১৯৪৫ সালে ভারতেশ্বরী হোমস-এ রূপলাভ করে। ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পিতার নামে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ স্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালে রণদাপ্রসাদ তাঁর সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ গরিবদের উদ্দেশে ব্যয় করার জন্য কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল নামে অলাভজনক প্রাইভেট কোম্পানি রেজিস্টার্ড করেন। মীর্জাপুরে ডিগ্রি মহিলা কলেজ কুমুদিনী মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৪৩-৪৪ সালে সংঘটিত পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় রেড ক্রস সোসাইটিকে এককালীন তিন লাখ টাকা দান করেন এবং ক্ষুধার্তদের জন্য চার মাসব্যাপী সারা দেশে দুইশত পঞ্চাশটি লঙ্গরখানা খোলা রাখেন। এ ছাড়া তিনি টাঙ্গাইলে এস. কে. হাই স্কুল ভবন নির্মাণ এবং ঢাকার কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটালের (সিএমএইচ) প্রসূতি বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রণদাপ্রসাদের ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকহানাদার বাহিনী রণদা ও তাঁর ২৬ বছর বয়সী সন্তান ভবানীপ্রসাদ সাহাকে (রবি) তুলে নিয়ে যায়। এক সপ্তাহ পর তাঁরা বাড়ি ফিরে এলেও পুনরায় ৭ মে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁদের আর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। ওই সময় তিনি পুত্রবধূ স্মৃতি সাহা (২০০৫ সালে রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত) ও পৌত্র রাজীবকে রেখে যান।

মানবতাধর্মী কাজে সম্পৃক্ত থাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার রণদাপ্রসাদ সাহাকে রায় বাহাদুর খেতাব প্রদান করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মানবসেবায় অসামান্য অবদান রাখায় ও তাঁর কাজের যথাযথ স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করেন।

তথ্যসূত্র :

১। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সম্পাদনা : সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত এবং অঞ্জলি বসু, ১ম খণ্ড, সংশোধিত পঞ্চম সংস্করণ, সাহিত্য সংসদ, ২০১০, কলকাতা।

২। আলোকিত বাংলাদেশ, হাসান আলী, প্রবীণ কথা।