প্রশ্ন ফাঁস

অভিভাবকদের হাতেও হাতকড়া চাই

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আসা কয়েক  বছরের মধ্যে সবচেয়ে আনন্দদায়ক একটা খবর পড়লাম বৃহস্পতিবার। খবরটি করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রত্রিকা প্রথম আলো। দু’জন প্রতিবেদক অনেক দিন লেগে থেকে একটি চমৎকার অনুসন্ধানী খবর বের করে এনেছেন। যে ধরনের খবর পড়ার জন্য এবং জানার জন্য আমার মন প্রায়ই ছটফট করত। আমি জানি, আমার মতো অনেকেই এমন খবরের প্রত্যাশায় থাকেন প্রতিনিয়ত। কারণ, সবাই চান যে বিষয়ে প্রতিবেদন হয়েছে তাতে একটা ইতিবাচক উন্নতি আসুক। আর এ বিষয়ে সক্রিয় থাকুক বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।    

খবরটি ছিল প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ক। তবে কোন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা এতে আসেনি। এসেছে প্রশ্ন ফাঁসকারিদের ঘৃন্য কার্যকলাপের বিস্তারিত বিবরণ এবং এই জঘন্য অপরাধীদের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়সহ প্রশ্ন ফাঁসের লোভনীয় প্রস্তাব গ্রহণ করা অভিভাবকদের কথা। প্রতিবেদনটি সম্ভবত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় করা হয়েছে। যাই হোক, প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতা একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর নাম দীপংকর। ইতোমধ্যে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সে এবং তার গোটা চক্র মিলে সুযোগ সন্ধানী অভিভাকদের কাছ থেকে ৪ কোটি টাকা নিয়েছে প্রশ্ন ফাঁসের বিনিময়ে। চক্রের সদস্য হিসেবে আছে চিকিৎসক, শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অর্থাৎ এই দলটিতে এমন কেউ নেই যারা বিদ্যা লাভ করেনি, যাকে বলে অশিক্ষিত, গোঁয়ার। এরা সবাই শিক্ষিত, যার যার পরিবার ও সমাজে তারা বেশ সম্মানিত। সমাজে মানের বিচারে এরা বেশ মানি-গুণি। কিন্তু কর্মটা কী করল? আমরা জানতাম শিক্ষা মানুষকে সৎ ও আদর্শবান হতে শেখায়। তাহলে এরা কী শিক্ষা পেল? নাকি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেই গলদ রয়ে গেছে? এই প্রশ্নে আরেকদিন লিখব।

আমার কাছে বেশি আনন্দ লেগেছে, এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ভূমিকা দেখে। দেশে একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। কিন্তু অস্বীকারের সংস্কৃতি আর অপরাধীদের দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরব ভূমিকায়ও মানুষ বেশ ক্ষুব্ধ। একটা দেশে অপরাধ হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হল অপরাধীদের দমন করা। কিন্তু অপরাধ দমনকারিরা যদি নাকে শর্ষে তেল দিয়ে ঘুমায় বা অপরাধীদের সঙ্গেই যোগ সাজস করে তখন কী উপায়? তখন তো সমাজে অপরাধের মাত্রা বাড়বেই। নানা রকম পদ্ধতি- উন্নত প্রযুক্তি বের করেও তাই প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না। সবশেষ বরগুনায় ২য় শ্রেণীর প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে!

এ অবস্থায় ‘প্রশ্নফাঁসের হোতাদের গ্রেপ্তার এবং তাদের কাছ থেকে ৪ কোটি টাকার চেক উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’- এমন খবর সত্যিই আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার মতো। একেবারে অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলো দেখার মতো বিষয়। বিশেষ করে, এই সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা যখন বলেন, এই গোটা চক্রের কাউকেই তাঁরা ছাড় দেবেন না এবং নিশ্চিতভাবেই বিচারের মুখোমুখি করবেন, তখন আশাবাদের জায়গা তৈরি না হয়ে পারে না। আমরা প্রায়ই নানা কারণে তাদের সমালোচনা করি। আমার মনে হয়, সমালোচনার পাশাপাশি এসব দারুণ কাজের জন্য প্রশংসা করেও প্রতিবেদন করা উচিত সংবাদ মাধ্যমের।

আমরা আশা করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই উদ্যোম বজায় থাকবে এবং তাঁরা এবার প্রশ্ন ফাঁসের একটা বিহিত করেই ছাড়বেন। তবে এই কলামটি লিখতে বসে আমার একটা বিষয়ে বেশি জোর দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। সেটা হল,  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ, তাঁরা যেন প্রশ্নফাঁস প্রক্রিয়ায় জড়িত কোন অভিভাবককেই না ছাড়েন। তাদেরও যেন দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির একটা ব্যবস্থা করা যায় সেই চেষ্টা যেন সবার থাকে।

প্রশ্ন ফাঁসকারিরা একটা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা শিশুকাল থেকেই চুরি শিখছে। তারা দেখতে পাচ্ছে, তাদের মহামান্য অভিভাকরাও কীভাবে অপরাধ করতে তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। এই প্রজন্ম বড় হলে এদের কাছ থেকে জাতি কী আশা করবে? সুতরাং প্রশ্ন ফাঁসকারিদের পাশাপাশি প্রলুব্ধ অভিভাবকদের হাতেও হাত কড়া দেখতে চাই আমরা। এবং তা গণমাধ্যমে প্রচারও করতে চাই। যাতে অন্য দশজন সুযোগ সন্ধানী অভিভাবকরা একটা শিক্ষা পায়। ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়া এই রোগ থেকে বাঁচতে এমন কঠিন পদক্ষেপই এখন নিতে হবে। এছাড়া আর উপায় নেই। আশা করি, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে আর সময় ক্ষেপন না করে এখনই দ্রুত ব্যবস্থা নিবেন।

লেখক: সাংবাদিক, আরটিভি