যেভাবে হিরো হলেন মোস্তফা
গত ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটের ৫৫ ভাগ অর্থাৎ এক লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। যা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ৯৮ হাজার ৮৯ ভোট বেশি। অনেকেই এই বিশাল ভোটের ব্যবধানকে ঐতিহাসিক বিজয় বলছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বিশাল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী সরফ উদ্দিন আহাম্মেদ ঝন্টুকে পরাজিত করে রাতারাতি জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে তাঁকে অনেকে গুরুত্ব না দিলেও তিনি সাধারণ মানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন- এটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। তাঁর এই ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা দেখে অবাক হয়ে গেছে পুরো বাংলাদেশের মানুষ। কে এই মোস্তফা? তাঁর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা হলো কীভাবে?
মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। বাবা মৃত আলহাজ মামদুহুর রহমান ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা আমেনা বেগম। তাঁর জন্ম ১৯৫৯ সালে মিঠাপুকুর উপজেলার কমরগঞ্জ গ্রামে। কমরগঞ্জ হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর রংপুরে চলে আসেন। ভর্তি হন উত্তরাঞ্চলের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজে। সেখান থেকে ১৯৭৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। এরপর আবার নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। সেখানে ১৯৮৩-৮৪ সালে কমরগঞ্জ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে দুই বছর শিক্ষকতা করার পর সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার রংপুর নগরীতে ফিরে আসেন। শুরু করেন ঠিকাদারি ব্যবসা। অল্প দিনের মধ্যেই বিদ্যুৎ বিভাগের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার হিসেবে তাঁর ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি করেন।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার পর তাঁকে কারাগারে আটক রাখার পর এরশাদ মুক্তি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদ কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় রংপুরের ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটি আসনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। কিন্তু মনোনয়নপত্র ঠুনকো অভিযোগে বাতিল করা হলে পুরো রংপুর অঞ্চলে তোলপাড় শুরু হয়। মানুষের মাঝে এভাবে ক্ষোভ তৈরি হয়- এরশাদ রংপুরের সন্তান, সে নির্বাচন করতে চায়, কেন তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হলো। শুরু হলো আন্দোলন, তখন জাতীয় পার্টির তেমন কোনো নেতা ছিল না, সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এরশাদের মনোনয়ন বাতিলের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের দামামা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে লাখো মানুষ এরশাদের মুক্তি আর তার মনোনয়নপত্র গ্রহণ করার দাবিতে জেলা প্রশাসকের বাসভবন আর ডিসি অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভ শুরু করলে অচল হয় পুরো রংপুর নগরী। এ সময় বিশালাকার লাঙল বানিয়ে সেটা নিয়ে এরশাদ মুক্তি আন্দোলনে অংশ নেন মোস্তফা। তাঁর লাঙ্গল এ সময় দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফলে দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হন তিনি। এভাবে রাজনীতি শুরু মোস্তফার। এরপর ১৯৯৪ সালে গঠিত জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সদস্য, এরপর পৌর কমিটির সাধারণ সম্পাদক, আট বছর সদর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। ২০০৯ সালে তিনি রংপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। এভাবেই আস্তে আস্তে তিনি তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তে থাকেন। বিশেষ করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গণসংযোগ করে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং সফলও হন মোস্তফা।
২০১২ সালে প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে দলের চেয়ারম্যান এরশাদ তাঁকে সমর্থন দেননি। অপরদিকে জাপার আরেকজন প্রার্থী আবদুর রউফ মানিক অংশ নেন। এ সময় জাতীয় পার্টির একটি অংশ সরফুদ্দিন ঝন্টুর পক্ষে কাজ করেন। সেই নির্বাচন নির্দলীয় হওয়ার পরেও হাঁস মার্কা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে ৭৬ হাজার ভোট পেয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির একটি অংশসহ অনেকেই সহায়তা করায় সরফুদ্দিন ঝন্টু এক লাখ ছয় হাজার ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন।
নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরের দিন থেকে তিনি রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেন। ভোটারদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ভোট দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। শুরু হয় তাঁর গণসংযোগ। বিগত ৫ বছরে তিনি রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় যান, এলাকার সমস্যাসহ বিভিন্ন জনহিতকর কাজে অংশ নেওয়া শুরু করেন। ফলে তিনি রংপুর সিটি করপোরেশনে ২০৪ বর্গকিলোমিটার এলাকায় দিনের পর দিন বছরের পর ঘুরে মানুষের মনে নিজের স্থান করতে সক্ষম হন। মজার ব্যাপার মোস্তফা নগরীর সবগুলো পাড়া-মহল্লার নাম জানেন এমনকি এলাকার বেশির ভাগ মানুষের নামও তাঁর মুখস্থ। তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখেন। কোনো এলাকায় সমস্যা হলে তিনি খবর পাওয়া মাত্র ছুটে যান। নগরীর কোনো মানুষ মারা গেলে তিনি কিছু হোক না হোক জানাজায় অংশ নিতেন। এভাবে মোস্তফা হিরো হয়ে যান। কিন্তু পুরো সিটি করপোরেশনে মোস্তফা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে- এ বিষয়টি দলের চেয়ারম্যান এরশাদ টের পান। ফলে এবার আর সেই ভুল করেননি। নির্বাচনের এক বছর আগেই তিনি তাঁর মেয়র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন।
নির্বাচনের ছয় মাস আগেই ১৯৩টি ভোটকেন্দ্রের সকল কেন্দ্রেই তিনি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মনিটরিং কমিটি গঠন করে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেন। ফলে নির্বাচনের আগেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছিলেন। ফলাফল তাই হলো- তিনি প্রায় এক লাখ ভোটের বিশাল ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঝন্টুকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।