অভিমত

আলু ও পিঁয়াজ পরস্পর বিপরীতমুখী : স্বাভাবিক করা প্রয়োজন

Looks like you've blocked notifications!

কখনো কখনো কোনো কোনো কৃষিপণ্য কৃষক এবং সাধারণ মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। সাম্প্রতিককালে তেমনি দুটি কৃষিপণ্য সারা দেশের মানুষকে বেশ ভোগাচ্ছে। তার একটি আলু এবং আরেকটি পেঁয়াজ। আলু সবকিছুতেই লাগে এবং পিঁয়াজ আলুর তুলনায় কম লাগলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য। আলু বেশির ভাগ সময়ই সবজির বিকল্প হিসেবে খেতে হয়। অপরদিকে পিঁয়াজ মসলা হিসেবে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য মূল্যের জন্য এখন একে অপরের বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। এ সম্পর্ক আমাদের মানুষের জন্য, অর্থনীতির জন্য, সরকারের জন্য এমনকি সার্বিকভাবে দেশের জন্য কোনোরকমেই ভালো নয়।

এক বছর ধরে বাজারে আলুর দাম ক্রমহ্রাসমান হয়ে খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। অপরদিকে বিগত প্রায় তিন-চার মাস ধরে পেঁয়াজের মূলের ক্রমবর্ধমান অবস্থা সব আয়ের মানুষকে তাদের  পারিবারিক বাজেটকে একহাত করে ক্ষতির সম্মুখীন করে দিয়েছে। অথচ আমাদের দেশের কৃষির অবস্থার সাথে তা কোনোটিই স্বাভাবিক নয়। কারণ দেশের বেশির ভাগ এলাকাতেই আলু এবং পিঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। এ দুটি একই ঋতু অর্থাৎ রবি মৌসুমের ফসল। সারা দেশে প্রতিবছর আলু এখন এত বেশি পরিমাণে ফলছে যে চাহিদা এবং জোগানের বেড়াজালে পড়ে সেটার দাম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।

অথচ আমরা জানি আলু অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি ফসল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে পরিমাণ আলু আমাদের বর্তমানে দৈনন্দিন চাহিদায় প্রয়োজন। তার থেকে অনেক বেশি উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও চাহিদার অতিরিক্ত পরিমাণ বিদেশে রপ্তানি করা করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। পচনশীল একটি পণ্য হওয়ায় এতে অনেক আলু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক বিপরীত হলো পেঁয়াজের ক্ষেত্রে। প্রতি বছর আমাদের যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হওয়ার কথা তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ আমাদের চাহিদা। কিন্তু নিজস্ব উৎপাদিত পেঁয়াজে আমাদের সারা বছরের সারা দেশের চাহিদা না মেটাতে পারার কারণে প্রতিবছরই আমাদের পেঁয়াজের আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হয়।

দেখা গেছে স্বাভাবিক সময়ে এগুলোর দাম কিছুটা নাগালের ভিতরে থাকলেও অব মৌসুমে দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে নাগরিক ভোগান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন এখন আলুর কথা ধরলে মৌসুমে নতুন আলুর দাম কেজিপ্রতি জাতভেদে ২০ থেকে ৪০ টাকা হলেও ঠিক একই সময়ে পুরাতন আলু একেবারে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হচ্ছে তাও আবার অনেকে তা আর সহজে কিনতে চায় না। অপরদিকে মাত্র এক মাস আগেও যে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকার উপরে ছিল এখন তা মৌসুমের ভিতর জাতভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকা বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে।

মাঝেমধ্যে তো পত্রিকান্তরে এমন খবরও উঠতে দেখেছি যে একমণ আলু দিয়ে মাত্র আধা কেজি পেয়াজ কেনা যাচ্ছে। তারমানে হলো- তখন প্রতিকেজি পিঁয়াজের মূল্য যদি ১২০ টাকা হয়ে থাকে তখন একমণ আলুর মূল্য ছিল মাত্র ৬০ টাকা যা খুবই অনৈতিক ও অস্বাভাবিক। একমন একটি অবস্থায় একজন কৃষক স্বাভাবিকভাবেই আলু উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। তাতে আবার পরের বছর সমস্যা সৃষ্টি হবে নিশ্চিতভাবেই। কারণ ব্যবসার একটি সাধারণ নীতি রয়েছে। যে বছর কৃষক কোনো পণ্যের আবাদ করে তার সেই উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য পায়। তখন পরের বছর এর আবাদও বেড়ে যায়। অপরদিকে কোন বছর কোন উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মুল্য কম থাকলে পরের বছর কৃষক আর সেটি তেমনভাবে উৎপাদনে আগ্রহ দেখায় না। সেজন্য স্বাভাবিক কারণে পরের বছর সেই পণ্যটির দাম বেড়ে যায়।

এগুলো কখনো কখনো বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। সেজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্বাভাস। আর আলুর মূল্য বৃদ্ধি করতে হলে উৎপাদন কমিয়ে নয়, বাড়াতে হবে এর বৈদেশিক রপ্তানি এবং বাড়াতে হবে বহুমুখী ব্যবহার। তা ছাড়া আলু শর্করা খাদ্যোপাদানের একটি অন্যতম প্রধান উৎস বিধায় ভাতের পরিবর্তে আলু খেতে হবে। অপরদিকে পিঁয়াজের আবাদ আরো ব্যাপকতর করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশের যেসব ব্যবস্থায় আলু উৎপাদিত হয়, ঠিক একই অবস্থায় পিঁয়াজও উৎপাদিত হয়। সেজন্য যেহেতু প্রতিবছর বিশেষ বিশেষ সময়ে অর্থাৎ রমজান মাসে অথবা অব মৌসুমে পিঁয়াজের মূল্য বেড়ে যায়। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে পিঁয়াজের আবাদ বাড়ালে সঠিক সময়ে দেশে পিঁয়াজের সরবরাহ নিশ্চিত হবে।

কাজেই আমাদের দেশের দুটি কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও মূল্যের ওপর সরকারও অনেক সময় বিপাকে পড়ে যায়। অথচ এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবার একটু সচেতনতা এবং পূর্ব পরিকল্পনা এ থেকে অতি সহজেই পরিত্রাণ দিতে পারে। যে বছর দেখা যাবে কোনো কারণে পেঁয়াজের উৎপাদনে কিছুটা পিছনে পড়ে গেছে। সেবছর আগে থেকেই পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা নিতে হবে। আবার যেবছর দেখা যাবে আলুর উৎপাদন বেড়ে গেছে অর্থাৎ ফলনে বাম্পার হয়েছে, সেই বছর আগে থেকেই আলু রপ্তানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এভাবেই এ ফসলগুলোর ব্যাপারে পূর্বাভাস ও সতর্কতা গ্রহণ করলে সুফল পাওয়া যাবে। দেশের সচেতন ব্যক্তি, কৃষি বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ তদসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এতে সহযোগিতা দিতে পারেন। আর এতে দেশ-জাতি সবাই উপকৃত হবে। 

লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়