ক্রিকেট

বাংলাদেশ এখন জয়ের ঘোষণা দিয়েই খেলে

Looks like you've blocked notifications!

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যখন ছিলাম, তখন বাংলাদেশ অনেকটা একনায়কনির্ভর দল। নায়কের নাম মোহাম্মদ আশরাফুল। হাবিবুল বাশারসহ কয়েকজন পার্শ্বনায়ক থাকলেও তখন ব্যাপারটা ছিল এ রকম—আশরাফুল যদি কিছু একটা করে, এই আশায় সবাই খেলা দেখতে বসতাম। যখনই তিনি আউট হতেন, অমনি সবাই টিভি রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতাম। আর আশা নাই। এটা-সেটা গালি দিতাম। বলতাম, বাঙালিকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না! এই দল কবে মানুষ হবে, কবে আমরা বিশ্বমানের হব—এসব আফসোস করতে করতে রুমে ফিরে যেতাম। বিরক্তির শেষ থাকত না।

কিন্তু আশ্চর্য এই, পরদিনই কিংবা পরের সপ্তাহেই আবার যখন বাঙালি মাঠে নামত, হলের টিভি রুম কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যেত প্রথম থেকেই! একটিও চেয়ার খালি পড়ে থাকত না। টস জিতলে করতালিতে গমগম করত গোটা হল। আশরাফুল একটা চার মারলে কিংবা মাশরাফি একটা উইকেট নিলে শতকণ্ঠের গর্জন উঠত সেখানে। ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ স্লোগানও উঠে যেত। আগের দিনের বিরক্তি নিমেষেই ভালোলাগায় বিলীন হয়ে যেত। ক্রিকেটের প্রতি আমাদের এই আবেগ-ভালোবাসা অমোঘ। এই সত্য লুকানোর কিছু নেই। বাংলাদেশ হারলে আমরা ক্রিকেটারদের অভিসম্পাত করব ঠিকই। কিন্তু পরদিন ঠিকই আবার টিভি সেটের সামনে বসে যাব চানাচুর বা চিপসের প্যাকেট হাতে করে! জয়ের নেশায় বুঁদ থাকব ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এটাই বাস্তব।

সত্যি যদি বলি, আমাদের তখনকার তারুণ্য বিশ্বাস করেনি, বাংলাদেশ এখনকার মতো বলেকয়ে কাউকে হারাতে শিখবে। এখন জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলংকার মতো দল সামনে এলেই বাংলাদেশ বলে, ‘আমরা জিতব।’ এই যে ত্রিদেশীয় সিরিজ শুরু হলো, এতে কৌশল হিসেবে না বললেও বাংলাদেশ কিন্তু ধরেই নিয়েছে ‘আমরাই ফেভারিট’। এবং খুব খারাপ কিছু না ঘটলে এই সিরিজটি বাংলাদেশ জিততে যাচ্ছে—এমন বিশ্বাস আমাদের সমর্থকদের মধ্যেও ঢুকে গেছে। এমনকি ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকেও হারানোর মানসিকতা নিয়েই টাইগাররা এখন মাঠে নামে, যদি দেশের মাটিতে খেলা হয়।

এই যে একটা অবিশ্বাস্য রকমের পরিবর্তন ক্রিকেটারদের এবং আমাদের মনোজগতে এসেছে তার বদৌলতে এখন আমরা ব্শ্বিাস করি, বাংলাদেশ বছরে ১০টা ম্যাচ খেললে ৬টাতে জিতবে। কিংবা নিদেনপক্ষে ৫-৫ হবে। এখন বাংলাদেশ ওয়ানডের মতো টেস্টেও খেলতে নামে জয়কে নিশানা করেই। বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের মনে এই বিশ্বাসও জন্মেছে যে, বিশ্বের যে কাউকেই এখন আমরা হারাতে পারি। সেটা ওয়ানডেতে, যেমন তেমনি টেস্টেও।

২০১৮ সালের শুরুটাও বাংলাদেশ করেছে এমন আত্মবিশ্বাসের পরিপূর্ণ বিস্ফোরণ দিয়েই। কিছুদিন আগে শ্রীলংকার মাটিতে তাদের হারানো জিম্বাবুয়েকে অনেকটা উড়িয়ে দিয়ে ৮ উইকেটের যে জয় মাশরাফি বাহিনী তুলে নিয়েছে তা নিছক একটি জয়ের চেয়েও বহুকিছু। অনেক বিষয়েই প্রাপ্তিযোগ আছে এই জয়ে। প্রথম প্রাপ্তিটা হলো, ঠিকঠাকভাবে বছরটা শুরু করা। ক্রিকেটীয় বিচারে বাংলাদেশ এখন জিম্বাবুয়ের চেয়ে শ্রেয়তর দল। সুতরাং জয়টাই ছিল প্রাপ্য। সেই কাজটা সুচারুভাবে করা গেছে—এই স্বস্তিটাও একটা প্রাপ্তি। কয়েক বছর ধরে উন্নতির যে ধারাবাহিকতা, তা না আবার থমকে যায়, এমন একটা শঙ্কা ছিল অনেকের মনে। তাও দূর হলো তামিমের অপরাজিত ৮৪ রানে ভর করে পাওয়া এই জয়ে।

প্রাপ্তির খাতায় বছর শুরুর এই জয়ে আছে আরেকটি খুবই কাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সেটি হলো, ‘কাটার’ ফিরে পাওয়া। যেন মাঠের মুস্তাফিজ নয়, গোটা বাংলাদেশ ফিরে পেতে যাচ্ছে এই অস্ত্র। মুস্তাফিজের কাটারে ভর করেই ২০১৬ সালে একটা অসাধারণ বছর পার করেছিল মাশরাফির বাংলাদেশ। যে বছর টানা পাঁচটা সিরিজ জয়ের রেকর্ড করেছিল টাইগাররা। ইনজুরি আর অপারেশনের ধকল সামলে সাতক্ষীরার বিস্ময় বালক মাঠে ফিরলেও গত বছর পুরোটাই আমাদের কেটেছে ‘কাটার’ না পাওয়ার বেদনায়। অবশেষে জ্বলে উঠতে শুরু করেছেন ‘কাটার মুস্তাফিজ’। তাঁর হাতের কাটার ফিরে পাচ্ছে পুরোনো ধার। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বছর শুরুর এই ম্যাচ টাইগারভক্তদের সম্ভবত সবচেয়ে বড় সুখবর দিয়েছে এটিই। নিজের জন্য নির্ধারিত ৬০ বলের মধ্যে এদিন ৪২টিই ডট বল করেছেন কাটার-মাস্টার।

বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বছর শুরুর জয়কে প্রধান শিরোনাম করেছে। শিরোনামের ভাষাটা ছিল এমন, ‘আঠারো’য় শুভ সূচনা বাংলাদেশের’। এটি আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। জাতি হিসেবে ক্রিকেটপাগল বাঙালির জন্য এটি হবে পরম পাওয়া। কারণ, আরেকটি দিক থেকে এই বিশেষ বছরটা অন্ধকারের কানাগলির ছবি দেখাচ্ছে আমাদের। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার বছর হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক যদি-কিন্তু নির্ভর এই বিশেষ বছরটি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মাশরাফি-তামিমরা যে নতুন বছরে শুভসূচনা করেছে তার মূল্য অপরিসীম। আমি তাদের স্যালুট জানাই।

আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে পূজা করি। তাঁরা আমাদের এই দীন দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটান; ১৬ কোটি মানুষকে আনন্দে ভাসান। আসুন আমরা আমাদের এই বীর সেনানীদের জন্য প্রার্থনা করি। তারা যেন গোটা ২০১৮ সাল জুড়েই জাতিকে জয়ের আনন্দে ভাসাতে পারেন। ক্রিকেট মাঠে আঠারো সাল হোক দুরন্ত। সব বাধা-বিপত্তি পেছনে ঠেলে টাইগারদের হাত ধরে আঠারোর জয়ধ্বনি হোক বছরজুড়ে।

লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি।