ক্রিকেট

স্মিথের মর্মস্পর্শী কান্না এবং

Looks like you've blocked notifications!

কান্না। বহুমাত্রিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু কী! ক্রিকেটবিশ্ব বহু কান্না দেখেছে। আগামীতেও হয়তো দেখবে। কিন্তু কিছু কান্না ক্রিকেটীয় ক্যানভাসে অন্য রকম দাগ রেখে যায়। সময় বদলায়। দৃষ্টভঙ্গি পাল্টায়। কিন্তু ক্রিকেট ক্যানভাসের সেই কান্না মনে হয় সদ্য তুলির টানে ভেজা! বিশেষ করে বড় তারকাদের ভেজা চোখ আমজনতার কাছে বেশিরভাগ সময় মর্মস্পর্শী। কিছু কান্না ক্রিকেট রোমান্টিসিজমের অংশ হয়ে যায়।

এবং সেটাও খুব স্বাভাবিক। কারণ, ক্রিকেটের তাঁরা কী বোঝেন, যাঁরা শুধু ক্রিকেট বোঝেন! হ্যান্সি ক্রনিয়ে থেকে কপিল দেব। মোহম্মদ আশরাফুল থেকে স্টিভ স্মিথ। সাম্প্রতিক সময়ে এঁদের ভেজা চোখ দেখেছে ক্রিকেট সমাজ। এঁরা প্রত্যেকে কেঁদেছেন। তার আবহ ভিন্ন। কারণ ভিন্ন। কিন্তু কান্না এক। এঁদের কান্নার দৃশ্য অনেক মানুষের চোখকেও ভিজিয়ে দিয়েছে। সব শেষে উদাহরণ স্টিভেন স্মিথের কান্না। অস্ট্রেলীয়দের নির্মম পেশাদারিত্বের মোড়কেও আটকে রাখতে পারলেন না তিনি নিজের কান্না।

কেপটাউনে বল টেম্পারিং-কাণ্ডে বিপর্যস্ত, নির্বাসিত স্মিথ সিডনি বিমানবন্দরে পা রেখে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে একপর্যায়ে ভেঙে পড়লেন। শিশুর মতো কাঁদলেন। তাঁর কান্না দেখে স্তব্ধ ক্রিকেটবিশ্ব। স্মিথ ক্ষমা চেয়েছেন। দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সঙ্গে আরেকটা কথা বলেছেন : ‘যা ঘটল তা আমাকে বাকি সারাটা জীবন তাড়া করে বেড়াবে।’
শেষ বাক্যটা ভবিষ্যতের। স্মিথের কান্না বর্তমান। কিন্তু ফ্ল্যাশব্যাকে আছে অতীতের অনেক কান্না। ম্যাচ ফিক্সিং-কাণ্ডে অন্তর্দহন আর হৃদয়ের রক্তক্ষরণে কেঁদেছিলেন হ্যান্সি ক্রনিয়ে। কেঁদেছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। হ্যান্সি-আশরাফুলদের বিবেক জাগ্রত হয়েছিল। সত্য স্বীকার করেছিলেন। সেই পথে হাঁটলেন স্মিথও। অপরাধ স্বীকার করে নিলেন।

কান্না। নির্ভেজাল আবেগ। কিন্তু অপরাধ বিভিন্ন নিক্তিতে মাপা হয়। বিচার হয়। স্মিথেরও ক্রিকেট আইনে বিচার হয়েছে। সেই বিচার নিয়ে অনেক চর্চা হচ্ছে। তাঁর কান্না দেখে অনেকে সহানুভূতি প্রকাশ করছেন। পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তবে কলঙ্কের দাগ স্মিথের গায়ে লেগেছে। ক্রিকেটীয় শুভ্রতার ওপর কালির ছোপ পড়েছে। সময় নামক ডিটারজেন্টে সেটা মুছে যাবে, তাও মনে হয় না।

তবে কান্নাভেজা কণ্ঠে স্মিথ আরো একটা কথা বলেছেন।‘ক্রিকেট আমার জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’ সেই জীবন কি থেমেই গেল। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া আর স্মিথের ফর্ম আগামীতে ওই প্রশ্নের উত্তর দেবে। তবে আপাত ব্রেকে স্মিথ তাঁর ক্রিকেটীয় সত্তাকে বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ মুহূর্তে সত্তাটা বেঁচে থাকলেও বুকটা পোড়া! এবং সেই পোড়াবুকে সত্যিই দারুণ খরা! চোখের জলে সেটা ভেজে না।

স্মিথের পোড়া বুকে যতই খরা থাক, সেখানে অন্য রকম এক ক্রিকেটীয় সত্তার সবুজ আভাও দেখে যায় নাকি! অনন্ত যাঁরা ক্রিকেটের মধ্যে শুধু ক্রিকেটকে খোঁজেন না। বা ক্রিকেট দিয়ে শুধু ক্রিকেটকে বোঝার চেষ্টা করেন না। তাঁরা নিশ্চয়ই দেখছেন। ক্রিকেট শুধু একটা খেলা নয়। ক্রিকেট একটা দর্শন। একটা সংস্কৃতি। একটা জাতির জাতিসত্তার অন্য রকম প্রকাশও। হালে খেলাটার প্রবল বাণিজ্যিকীকরণের চাপে সেই সত্তাটার চিড়ে-চ্যাপ্টা অবস্থা। যেখানে জয় আর অর্থই শেষ কথা! অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দর্শনেও জয়ই শেষ কথা। তার জন্য কোনো ক্রিকেটার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দলের জয় নিশ্চিত করতে চান। কিন্তু সেই লড়াকু অস্ট্রেলিয়ানদের গায়ে ‘প্রতারক’-এর সাইনবোর্ড! স্বাভাবিকভাবেই অস্ট্রেলিয়ানদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া : ‘স্টিভ হ্যাজ লেট আস ডাউন।’ কিন্তু স্মিথের কান্না অনেক অস্ট্রেলিয়ানের বুকেও অন্য রকম স্পন্দন জাগাল। ‘ওরা তো খেলাটার আইন ভেঙেছে। খুন তো আর করেনি! কিন্তু বিনা খুনে একজনের হৃদয়ে দারুণ রক্তক্ষরণ।’ 

এবং তিনি স্মিভেন স্মিথ। ক্রিকেটের স্পিরিটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেও ক্যাপ্টেন্সির স্পিরিটটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে গেলেন নাকি তিনি শেষ পর্যন্ত। অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া থেকে বিশ্ব, ক্রিকেট বল টেম্পারিং-কাণ্ডে স্মিথ নয় খলনায়ক হিসেবে দেখছে একজনকেই। তিনি স্মিথের ডেপুটি ডেভিড ওয়ার্নার। কিন্তু অধিনায়ক স্মিথ অন্য কারো ওপর দায় চাপিয়ে পার পেতে চাননি। কান্না ভেজা কণ্ঠে স্মিথ অধিনায়কত্বের যে স্পিরিট তার জয়গানই গেয়ে গেলেন। ‘আমি কাউকে দায়ী করছি না। আমি অধিনায়ক ছিলাম। সব দায় আমার।’

ক্রিকেট নামক খেলাটায় অধিনায়কই শেষ কথা। অন্তত মাঠে। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে খেলাটার যতই পরিবর্তন ঘটুক, যতই ক্রিকেটে হেড কোচ, বোলিং কোচ, ফিল্ডিং কোচ, ফিজিও, মনোবিদ, ম্যানেজার, কোচিং স্টাফ নামক শব্দগুলোর আমদানি ঘটুক, দলের যাবতীয় সংকটে অধিনায়ককেই নেতার মতো দাঁড়িয়ে যেতে হয়। দলের সাফল্যের ভাগ নেওয়ার জন্য এখন কোচ, ম্যানেজার থেকে শুরু করে পারলে বোর্ড সভাপতিরাও মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে যান। কিন্তু ব্যর্থতা, দলের বিপর্যয়ে এঁদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। স্টিভ স্মিথ ক্রিকেট সংস্কৃতির এ রকম দারুণ খরার মধ্যে অধিনায়কত্বের স্পিরিটের ছোট একটা চারা রেখে গেলেন কী! যার হালকা সবুজ পাতা হয়তো আমরা আগামীতে দেখব!

সাফল্যের শৃঙ্গে উঠতে গিয়ে স্টিভ স্মিথ গড়িয়ে পড়ে গলেন। কিন্তু তাঁর মর্মস্পশী কান্না ক্রিকেটের মুখ থেকে অন্য রকম স্বীকারোক্তিও বের করে নিল নাকি? ক্রিকেটে দিন শেষে অধিনায়কই শেষ কথা। ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা না থাকলেও এখল ‘ক্যাপ্টেন’স গেম’।

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট।