পাঠকের প্রতিক্রিয়া

ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি ও মিডিয়ার ভূমিকা

Looks like you've blocked notifications!

হাঁসরূপী জিউসের দ্বারা লেডাকে সম্ভোগের যে পৌরাণিক গল্প চালু আছে, সেটিই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ষণের ইতিহাস। ওই গল্পটিই সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত ধর্ষণের কাহিনী। এ তো গেল প্রাচীন গ্রিক পুরাণের কথা। সেমেটিক ও ভারতীয় পুরাণসহ আরো যেসব পুরাণ ও সাহিত্য প্রচলিত আছে, তাতে কি কোনো ধরনের ধর্ষণের ইতিহাস নেই? আছে। ভালোভাবেই আছে। ভারতীয় পুরাণ ও সেমেটিক পুরাণে ধর্ষণচিত্রের অভাব নেই। ধরুন পাণ্ডবদের দ্বারা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ইতিহাস কি শুধুই পৌরাণিক? না অন্য কিছু? বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে এটি ধর্ষণই, তা ছাড়া আর কিছু নয়। আবার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য—দেশে-বিদেশে, ভরে আছে ধর্ষণের নানা রগরগে কাহিনী দ্বারা। কিন্তু কোনো সমাজই এই ধর্ষণকে প্রতিহত করেনি, স্থান দিয়েছে ধর্মে, পুরাণে, সাহিত্যে। তাই বলা চলে যে ধর্ষণ কোনো একটি সময়ের বিষয় নয় বা কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে ধর্ষণের উদ্ভব হয়েছে এমন নয়, একটি বিশেষ ইতিহাস রয়েছে। তাই হঠাৎ করেই যাঁরা একদিনেই ধর্ষণকে সমাজ থেকে দূর করতে চান, তাঁদের দেখলে হাসি পাই, করুণারও উদ্রেক হয়। তাই ধর্ষণ প্রতিরোধ বিষয়ে কথা বলতে গেলে আমদের উচিত হবে পেছনের ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করা।

বর্তমানে ঘটে যাওয়া যেকোনো ধর্ষণের খবর মিডিয়ার কল্যাণে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে। সকলে একনজরেই জানতে পারে, পৃথিবীর কোথায় ধর্ষণ হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন ও মধ্যযুগে এটি সম্ভব হয়নি, হওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে আমরা জানতে পারি না, প্রাচীন ও মধ্যযুগে কীভাবে ধর্ষণ হয়েছিল এবং কতসংখ্যক ধর্ষণ হয়েছিল। আর প্রাচীন ও মধ্যযুগে যাঁদের হাতে ইতিহাস রচিত হয়েছিল, তাঁরা স্বাধীন ছিলেন না। ফলে তাঁদের পক্ষে রাজা-রাজড়াদের বিপক্ষে গিয়ে কিছু লেখা সম্ভব ছিল না। রাজা-রাজড়াদের পক্ষে লিখতে গিয়ে আসল সত্যকে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সাহিত্য ও পুরাণের অনেক বাস্তব কাহিনীই তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে।

পৃথিবীর সকলেই একবাক্যে ‘তাজমহল’কে সর্বাগ্রে বিবেচনা করবে, স্থাপত্যের দিক থেকে, ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে। কিন্তু সকলে শাহজাহান-মমতাজের বিষয়টি দেখে, দেখে না একটি বিষয়, অন্তঃপুরে শাহজাহানের রক্ষিতাদের খবর। আর সুন্দরী রক্ষিতাদের শাহজাহান যে কেন হাজার হাজার মুদ্রা ব্যয় করে রেখেছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে খবর কেউ নিতে চাই না। কিন্তু ধর্ষণের প্রাচীন ইতিহাস খুঁজতে গেলে অবশ্যই একজনের উচিত হবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সামাজিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করে ফেলা। তারপর উচিত সামনে এগিয়ে যাওয়া।

দেশে হঠাৎ করেই ধর্ষণের মাত্রা বেড়ে গেছে, আগের সব রেকর্ডকে ভেঙে দিয়ে। এর কারণ খুঁজছেন সকলে, চাচ্ছেন বিচার। নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ এই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু কোনো কাজ কেন হচ্ছে না? ফল কেন ফলছে না? এটি একটি বড় প্রশ্ন। প্রাচীন ও মধ্যযুগে সামন্ত সমাজে ধর্ষণের একটি সীমা ছিল—বয়স ও রুচির দিক থেকে। কিন্তু বর্তমানে সে সীমা কি অতিক্রম করেনি? যদি অতিক্রম না করত, তবে কীভাবে পাঁচ বছরের একটি শিশু ধর্ষণের স্বীকার হতে পারে, শুধু ধর্ষণই নয় ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যাকাণ্ড!

ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিচার হচ্ছে না। ধর্ষণ থেকে বেঁচে আসার পর বিচার চাইতে গেলে আবার ধর্ষণের স্বীকার হতে হচ্ছে বা স্বীকার হতে হচ্ছে হত্যাকাণ্ডের—যেমনটা দেখলাম আমরা বিউটি আক্তারের বেলায়। এখন প্রশ্ন হলো, ধর্ষণের পেছনে মিডিয়ার কোন ভূমিকা আছে কি?

টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা ও খলনায়ক মিশা সওদাগরের মধ্যে ধর্ষণ নিয়ে যে ধরনের আলাপ হয়েছে, তা কি এই যুগেও কল্পনা করা যায়? রেপ-ভায়োলেন্সের তকমা বহুদিন থেকেই মাথার ছাতার মতো হয়ে আছে বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে। আর এ দুজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর মধ্যে যে আলাপ হয় এবং এই আলাপে তাঁরা দুজন ধর্ষণ বিষয়ে যেসব কথা বলেছেন, তা অবশ্যই নিন্দনীয়, নিন্দিত হয়েছে সর্বমহলে। এবং এই আলাপ যে ধর্ষকদের আরো অনুপ্রাণিত করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কথার সূচনার কারণ এই যে, মিডিয়া কীভাবে ধর্ষণকে দেখে তা বোঝা যায় এই অনুষ্ঠান থেকে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কয়েকটা ধর্ষণের খবর পাষাণহৃদয়ের মানুষকেও ব্যথিত করবে, নিশ্চিত করে বলা যায়। যেমন পাঁচ বছর বয়সের শিশুর যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে চিরে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এটি যে কত বড় বিকৃত মানসিকতার পরিচয়, তা বোঝানো যাবে না। আগে ধর্ষণের শিকার হতো গৃহবধূ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কলেজছাত্রী, স্কুলছাত্রী, আর এখন হয় পাঁচ বছরের শিশু! এরপর কী অপেক্ষা করছে? কে জানে! কিন্তু  শিশু ধর্ষণের এই বিষয়টিও খুব রগরগেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে মিডিয়ায়। যা হওয়া উচিত ছিল না, কিন্তু হয়েছে স্বার্থের জন্য। প্রকাশ পেয়েছে মিডিয়ার ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির। এবং এই সংবাদে শিশু ধর্ষণ কি থেমে যাবে? যাবে না। বরং বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হবে ধর্ষকরা এবং এ ধরনের বিকৃত ধর্ষণ ক্রিয়াতে জড়িয়ে পড়বে অনেকেই; আবার যা আশঙ্কার, দুঃখের তো অবশ্যই। তাই ধর্ষণ বন্ধে মিডিয়ার উচিত যথাযথভাবে খবর প্রচার করা।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।