বাংলা নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব

Looks like you've blocked notifications!

বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি। তা ধর্মীয় উৎসব হোক বা লোকজ উৎসব। চিরায়ত উৎসব উদযাপনের পর আবার নতুন নতুন উপলক্ষ খুঁজে উৎসবের মিছিল বড় করতে পছন্দ করে। ধর্মীয় উৎসব তা দুর্গা পূজা হোক বা ঈদ, সব কিছুতে সানন্দে অংশ নেয় ধর্ম নির্বিশেষে সব আত্মীয়, প্রতিবেশী ও বন্ধুরা। আবহমান কালের বাঙালি ধর্মীয় রক্ষণশীল চিন্তা দিয়ে নিজেকে সংকীর্ণ করেনি। আর লোকজ উৎসবগুলো তো ঝর্নাধারার মতো উৎসারিত হয়ে ছড়িয়ে পরেছে।

বর্ষবরণ পৃথিবীর প্রায় সব জাতিসত্তাই যার যার মতো করে উদযাপন করে থাকে। পয়লা বৈশাখকে বর্ষশুরুর দিন হিসেবে সুনির্দিষ্ট করার অনেক আগে থেকেই কৃষিজীবী বাঙালি ফসল বোনা আর ফসল ঘরে তোলা নিয়ে নানা উৎসব করে আসছিল। পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর মানুষ থেকে শুরু করে ধর্ম নির্বিশেষে সব বাঙালি মুখর হয়েছে এসব লোকজ উৎসবে। মোগল যুগে সম্ররাটের অন্তঃপুরে নওরোজ উৎসবের আয়োজন হতো। পারস্য থেকে এই নববর্ষ পালনের ধারা মোগল অন্তঃপুরে জনপ্রিয় হয়ে পড়েছিল। এ ধারা আলোড়িত করে ভারতীয় জনমানসকে।

ষোল শতকের মাঝ পর্বে সম্রাট আকবর প্রবর্তিত বাংলা নববর্ষ ঘোষণার প্রেক্ষাপট এবং এর ছড়িয়ে পড়া স্পষ্ট করে এই উৎসবের পুরোটাই বাঙালির একান্ত লোকজ উৎসব। ধর্মীয় উৎসবের কোনো সংস্পর্শ নেই এখানে। দিল্লির অবাঙালি সম্রাট আকবরের কেন দায় পড়ল বাংলা নববর্ষ নির্দিষ্ট করে দেওয়া?  পুরোটাই সম্পর্কিত ছিল খাজনা আদায়ের প্রয়োজনে। এ যুগে মোগল বাদশাহ যেমন, স্থানীয় জমিদারও তেমন জনকল্যাণকামী প্রশাসন ছিল সবার। বাংলা ছিল মোগলদের গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ বা সুবাহ। এই সমৃদ্ধশালী সুবাহ থেকেই সবচেয়ে বেশি খাজনা যেত দিল্লিতে। কিন্তু দৈব দুর্বিপাকের কারণে মাঝে মাঝে ফসলহানি ঘটত। প্রজারা তখন জমিদারদের খাজনা পরিশোধ করতে পারত না। জমিদার খাজনা না পেলে মোগল রাজকোষেও খাজনা যেত না। এই বাস্তবতাকে আমলে এনে সম্রাট আকবর তাঁর বিখ্যাত অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমলকে দায়িত্ব দিলেন একটি উপায় বের করার জন্য। টোডরমল সিদ্ধান্তে এলেন। যে সময়টিতে ফসল কৃষকের গোলায় উঠে তখন খাজনা আদায় সহজ হবে। এই বিবেচনায় বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিকে বাংলা নববর্ষ ঘোষণা করা হলো। ফসলের সাথে সম্পর্কিত বলে ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দ ব্যবহারের আগে বাংলা সনকে ‘ফসলি সন’ বলা হতো।

যত দিন এ দেশে জমিদারি প্রথা টিকে ছিল তত দিন বাংলা নববর্ষকে ঘিরে ‘পুণ্যাহ’ বলে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ অনুষ্ঠান উদযাপন করা হতো। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রজা-জমিদারের মধ্যে একটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠত। চৈত্রের শেষ দিনটিতে জমিদারের সেরেস্তায় মহাসমারোহে খাজনা দিতে আসত প্রজারা। আলাদা একটি উদ্দীপনা ছিল সেখানে। এই উপলক্ষে নববর্ষের প্রথম দিন খাজনা দিতে আসা সব প্রজার দাওয়াত থাকত জমিদার বাড়িতে। ডাক পড়ত ঘোষদের। মণে মণে দুধ আসত। মিষ্টি বানানো হতো। জমিদার তদারকি করে যত্নে মিষ্টি খাওয়াতেন প্রজাদের।এতে প্রজারা খুব সম্মানিত বোধ করত। উৎসবের আয়োজন হতো জমিদার বাড়িতে। নাটমন্দিরে যাত্রা পালার আসর বসত। এই পুরো অনুষ্ঠান ‘পুণ্যাহ’ বলে পরিচিতি পায়। এই আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদযাপন সাধারণ গ্রামীণ সমাজের মানুষকে আলোড়িত করে। খাজনা আদায়ের ছলে সবাই এই সন্মান আর আনন্দ পেতে চাইত বলে পুণ্যাহের জন্য অধীর আগ্রহে পুরো বছর প্রতীক্ষা করত। হালখাতার আনুষ্ঠানিকতা তো এরই প্রতিফলন।

পয়লা বৈশাখ উদযাপনে তাই কোনো ধর্মীয় প্রেক্ষাপট কাজ করেনি। ক্রমে এই আনন্দ ধারা গ্রামীণ জীবনকে আলোড়িত করে। গ্রাম বাংলার উৎসব আয়োজন তো কৃষি জীবনকে ঘিরেই বেড়ে উঠেছে। পৌষের পিঠা পুলির আয়োজনের মধ্যদিয়ে পৌষ পার্বণে কি ধর্মীয় ছাপ দেওয়ার উপায় আছে। হিন্দু কৃষক, বৌদ্ধ কৃষক আর মুসলমান কৃষক একইভাবে ফসল উৎসব করে থাকে। এতে ধর্ম কখনো কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

মানতেই হবে পয়লা বৈশাখের মতো লোকজ উৎসভূমি গ্রামীণ জীবনেই। আগে তো বাংলা বৃহৎ অর্থে গ্রামই ছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগে নানা অংশে যে নগরায়ণ ঘটেছিল তাতে গ্রামীণ আচরণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ফলে চিরায়ত বাঙালির লোকজ উৎসব সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রচলিত পয়লা বৈশাখে এসে যেন একই মোহনায় মিলিত হয়ে আরো বেগবান হয়েছে। তাই গ্রাম বাংলায় পয়লা বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বৈশাখী মেলা, ব্যবসায়ীদের মধ্যে হালখাতা। ঘরবাড়ি সাফ-সুত্র করা, একটু ভালো রান্নার ব্যবস্থা করা। সাধ্যে থাকলে নতুন পোশাক পরা এসব বাঙালি সংস্কৃতির আবহমান কালের চর্চা।

বাঙালি যেমন লোকজ সংস্কৃতি চর্চা করে আবার তেমনি সারল্যপূর্ণ ধর্মচর্চা করে থাকে। এই দুই বিষয় কখনো কখনো একাকার হয়ে যায়। ধর্ম শুধু ধর্মীয় নয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আচরণও বটে। তাই বাঙালির উৎসব কখনো ধর্মীয় চেতনা বহিভূত হয়ে যায়নি। তবে সেখানে কোনো উগ্রবাদিতা জায়গা পায়নি। সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা কাজ করেছে। আর তাই লোকজ উৎসব থেকে উৎসারিত ব্যাবসায়ীদের হালখাতা উৎসবে অভিন্ন আয়োজন থাকছে। শুধু স্বাতন্ত্র থাকছে দিনের শুরুতে যার যার ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধের মধ্য দিয়ে। হিন্দু ব্যাবসায়ী হালখাতার সূচনায় পুরোহিত ডেকে পূজা অর্চনার ব্যবস্থা করছেন। ধূপ-ধূনো জ্বালাচ্ছেন। অন্যদিকে পাশের দোকানের মুসলমান ব্যবসায়ী মৌলবি সাহেবকে ডেকে মিলাদ পড়াচ্ছেন। আগরবাতির ধূয়োর হালকা সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে দোকানময়। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার পর উভয় দোকান থেকেই মিষ্টি বিতরণ হচ্ছে। লোকজ উৎসব বলেই সব আয়োজন ধর্মনির্বিশেষে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। বাঙালির লোকজ উৎসবের সৌন্দর্য এখানেই।

আধুনিক সময়ে নাগরিক সমাজে বর্ষবরণের নানা আনুষ্ঠানিকতার বিস্তারের ও একটি প্রেক্ষাপট ছিল। এর সাথে রাজনৈতিক শাসন শোষণেরও সম্পর্ক ছিল। পাকিস্তানি শাসক দল দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাভাষার ওপর হামলে পরেছিল। উদ্দেশ্য ছিল নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভোলাবে। কারণ বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন ও উজ্জ্বল। পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুভাষী শাসকদের শকুনি চোখ ছিল পূর্ববাংলার কৃষি সম্পদের ওপর। কিন্তু ওরা বুঝতে পেরেছিল সাংস্কৃতিক শক্তিতে বলিষ্ঠ বাঙালি প্রজন্ম এই শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবে। তাই ঐতিহ্যের উৎসে ফিরে যাওয়ার বাহন ভাষার ওপর আঘাত হানতে হবে। ভাষা ভুলাতে হবে। এজন্য সহজ উপায় ধর্মের বিকৃত ব্যবহার করা। তাই সেসময় ধোঁয়া তোলা হয়েছিল, বাংলা হিন্দুর ভাষা আর উর্দু মুসলমানের ভাষা। কিন্তু এই চক্রান্ত বাঙালি তরুণ রক্ত দিয়ে নস্যাৎ করে।

বুঝতে হবে হাজার বছর ধরে বেড়ে ওঠা বাঙালি সংস্কৃতি লোকজ ধারার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে। প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধ মতাদর্শের মধ্য দিয়ে মরমী ধারার নাথ মতবাদ সাধারণ মানুষের নৈকট্য পেয়েছিল। ব্রাহ্মণ সেন রাজাদের ধর্মীয় রক্ষণশীলতা সাধারণ বাঙালিকে বন্দি করতে চেয়েছিল ঠিকই কিন্তু ১৩ শতকের পরে মুসলমান সুলতানদের আগমন ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। সুলতানি ও মোগল যুগের প্রায় ৬০০ বছর বাঙালি লোকজ সংস্কৃতির চর্চা করেছে। শত শত বছর সুফি সাধকদের মরমী বাদী আচরণ ইসলামের মানবিক আবেদনকেই মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতরারই বিকাশ ঘটেছে। সামাজিক-ধর্মীয় বাস্তবতা ও সুফিদের মানবিক আচরণ ইসলাম প্রচারের রাতে তৈরি করেছিল। কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদ যখন এই জোয়ার থামাতে পারেনি তখন ১৬ শতকে শ্রীচৈতন্য দেব তাঁর নব্যবৈষ্ণব আন্দোলন নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। এখানেও ছিল মরমী ধারা। মানুষের প্রতি ভালোবাসা। আর এভাবেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিজয় হয়। ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু ধর্ম ও সমাজ রক্ষা করতে পেরেছিলেন চৈতন্য দেব। এই যে দীর্ঘকালীন মরমী ধারার মিশ্রণ এরই অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় মোগল যুগের শেষ দিয়ে এসে বাউল মতবাদের বিকাশ ঘটে। ধর্ম-সংস্কৃতির এই মানবিক দিকটি আবহমানকালের বাঙালি আপন করে নিয়েছে।

এভাবে বড় ক্যানভাসে আমরা যদি বাঙালির নববর্ষ উদযাপন দেখতে পারি সেখানে ধর্মীয় সংকীর্ণতা বিভেদ রেখা টানা সম্ভব হবে না। সম্প্রদায়গত সংঘাত তৈরির চেষ্টা করা নষ্ট মানুষগুলো বাঙালির প্রাণের উৎসবের জোয়ারে ভেসে যাবে।

লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।