২০১৫-এর অস্কারে আমার বাছাই

Looks like you've blocked notifications!
রিচার্ড ব্রডি। ছবি-টুইটার

এ বছরের সেরা মার্কিন ছবির স্বীকৃতি পেয়েছে ‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’ আবার একই ছবি  অস্কারেও সেরা ছবির ক্যাটাগরিতে মনোনীত, এমন ঘটনা একটু বিরলই বটে। ‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’-এর জন্য নিঃসন্দেহে বিষয়টি আনন্দের। মজার বিষয় হচ্ছে, বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই এই ধারাটা চলে আসছে- সেরা মার্কিন ছবি অস্কারের সেরা ছবির কাতারে প্রবেশ করতে পারে না- ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে ‘দ্য উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট’, ‘হুগো’, ‘দ্য ট্রি অব লাইফ’, ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ এবং ‘দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক’। এ ছবিগুলোর একটাও শেষ পর্যন্ত অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা ছবির পুরস্কারটা ঝুলিতে পুরতে পারেনি।

তবে ‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’ বছর সেরা নান্দনিক ছবির চেয়েও একটু বেশি কিছু! মনোনীত ছবিগুলোর দিকে একবার নজর দিয়ে দেখুন। প্রথমে যে চারটি ছবি নিয়ে বলব সেগুলো হলো ‘আমেরিকান স্নাইপার’, ‘দ্য ইমিটেশন গেম’, ‘সেলমা’ আর ‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’- এক্কেবারে বিষয়ভিত্তিক ড্রামা। এগুলোর ঘটনা থেকে বিষয়-আশয়, সবই সাম্প্রতিক। অন্য চারটে হলো- ‘বার্ডম্যান’, ‘বয়হুড’, ‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’ এবং ‘হুইপল্যাশ’- যেগুলো মোটামুটি কাহিনীচিত্র হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে এর মধ্যেও ‘বার্ডম্যান’ ছবির ক্ষেত্রে মাইকেল কিটনের বাস্তব জীবন কিংবা ‘বয়হুড’ আর ‘হুইপল্যাশ’ ছবিতে পরিচালক-লেখকদের নিজের জীবনের প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়ে গেছে।

‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’কে এক ‘ঐতিহাসিক মহাকাব্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও অত্যুক্তি হবে না। স্তেফান জ্যেইগের স্মৃতিকথা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব ইস্টারডে’ থেকে এর কাহিনী অনুপ্রাণিত। তরুণ বয়স থেকে পরিপক্ব হয়ে ওঠার সময় পর্যন্ত লেখকের ভিয়েনা আর অস্ট্রিয়ার স্মৃতি, ১৯৩৮ সালে নাজিদের জবরদখলের পর নিজ বাসভূমি হারানোর কষ্ট, তারপর গ্রেট ব্রিটেন থেকে যুক্তরাষ্ট কিংবা সেখান থেকে ব্রাজিল- ঘোরাঘুরি আর যাত্রা; সবশেষে ১৯৪২ সালে ব্রাজিলেই মৃত্যু। এই বিচিত্র উত্থানপতনের জীবনচক্রের দারুণ বিবরণ উঠে এসেছে এখানে।

ওয়েস অ্যান্ডারসনের মুন্সিয়ানা এখানেই। তিনি এমন এক গল্প বলেছেন যা ইতিহাস থেকে নেওয়া; কিন্তু উপস্থাপনের সময় তিনি সেখানে ইতিহাসের লেশমাত্র টানেননি। এ কারণেই সময়কালের সাপেক্ষে কোনোকিছুর উপস্থিতি মেলে না এ ছবিতে। এ ছবিতে সময়কে ভাগ করা হয়েছে চার ভাগে; সেখানে তিনি কল্পকাহিনীর আদলে হাজির করেছেন জুব্রোকা নামের এক দেশ- যেটি প্রকৃতপক্ষে অনেকটা অস্ট্রিয়ার মত, সেখানে নাজিমার্কা আধিপত্যের হদিস মেলে, সাথে সোভিয়েতের ছায়াও আছে! এটি অ্যান্ডারসনের আট নম্বর ফিচার ঘরানার কাজ (প্রথমটি ১৯৯৫ সালে, ‘বটল রকেট’) যেখানে তিনি তার নিজস্ব বিষয়ে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন অনন্যসাধারণ নান্দনিকতার বোধ।

এটা জিতুক আর না জিতুক, মনোনয়ন পেয়েছে। কারণ নতুন প্রজন্মের অস্কার ভোটাররা অ্যান্ডারসনের নন্দনবোধের সাথে বেড়ে উঠেছেন। আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে এর চেয়েও জরুরি- সিনেমাভোজীদের নতুন প্রজন্ম অ্যান্ডারসনের কাজের সাথে সাথে তৈরি হয়ে উঠেছেন; আর ছবিটিকে ‘হিট’ বানিয়েছেন। অ্যান্ডারসনের কাজের বৈচিত্র্য তাদের চলচ্চিত্রগত মূল্যবোধেরই একটি অংশ হয়ে উঠেছে। কতটা বৈচিত্র্য আর উদ্ভাবনী ভাবনায়, মজাদার আর জটিলতার কারুকাজে যে এ ছবিটি তৈরি, তা আপনাকে দেখতেই হবে! তবে আমার হিসেব বলে, এ মনোনয়নের পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক রয়েছে। ঐতিহাসিক কল্পকাহিনীর সাপেক্ষে এই ছবিতে অ্যান্ডারসন যেসব বিষয়-আশয় ব্যবহার বা সংযোজন করেছেন- সেগুলো তার আগের কাজগুলোর থেকে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। ভোটাররাও একে বিবেচনা করেছেন নিশ্চয়!

তবে, ইতিহাসভিত্তিক রাজনীতিকে গড়পরতায় বাহবা দেওয়ার প্রবণতা অস্কার ভোটারদের রয়েছে সবসময়ই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমালোচকরাও এই প্রবণতায় আক্রান্ত। চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী নয়, বরং তার ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ময়নাতদন্ত করেই চলে মান নির্ণয়ের খেলা। যেমন ‘আমেরিকান স্নাইপার’ ছবিতে যুদ্ধকে ‘মাহাত্ম্য’ দেওয়া হয়েছে কী হয়নি- এ নিয়ে তর্ক আছে। এমন যাচাই হয়েছে ‘সেলমা’ নিয়েও। এই দুটো ছবি এরইমধ্যে ‘মেরুকরণ’ হয়ে গেছে এই সাপেক্ষে- তাদের চলচ্চিত্রিক মূল্যায়ন বা নির্মাণশৈলী এখানে বিশেষ বিবেচ্য নয়।

‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’ এবং ‘দ্য ইমিটেশন গেম’ অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে নির্মিত ছবি হলেও ‘পোলারাইজড’ নয়। তবে সত্যি বলতে, এই ছবি দুটো বাজির দরে একটু দুর্বল। বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্বদের নিয়ে করা ছবির ভাগ্যে পুরস্কার বিশেষ জোটে না (সবশেষ ২০০২ সালে, ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’), ওদিকে আবার ব্রিটিশ বায়োপিকের ভোট এ দুটো ছবির ক্ষেত্রে ভাগাভাগি হয়ে যাবে। ফলাফলে হয়তো শেষ পর্যন্ত দুটোকেই বিদায় জানাতে হবে।

হাতে থাকে ‘বয়হুড’, ‘বার্ডম্যান’ আর ‘হুইপল্যাশ’। ‘হুইপল্যাশ’ এক ধ্রুপদি চিত্রনাট্য। একদম আটসাঁট এক কাহিনী, চরিত্রগুলোও একেবারে সাধারণ। নিজের তৈরি এক নরকে বসবাস করা এক ড্রামারের সংগ্রাম এবং সবশেষে এক দুর্দান্ত শিল্পী হয়ে ওঠা। সাফল্যর চূড়ায় পৌঁছাতে পথ যে কতটা কঠোর আর রুক্ষ হতে পারে; তা এই ছবিতে দেখানো হয়েছে তীক্ষ্ণভাবে। তারপরও সেরা ছবি হওয়ার দৌড়ে এ ছবি তেমন সম্ভাবনাময় নয়- এমন মানাই ভালো।

রইলো বাকি দুই, ‘বয়হুড’ আর ‘বার্ডম্যান’। এদের মাঝেই জমবে লড়াই। আমি বেছে নেব ‘বয়হুড’কেই। যৌবন নিয়ে সবারই আবেগ কাজ করে কমবেশি, মা-বাবাকেও সম্মান দেন প্রায় সবাই। এই ছবি তারচেয়েও একটু বেশি কিছু। রিচার্ড লিংকলেটারের চৌকস ধারণাশক্তি এখানে বিশাল এক নির্ধারক। নান্দনিকতার বিচারে অবশ্য ছবিটিকে তেমন বাহবা দেওয়ার কিছু নেই। আগস্টের মাঝামাঝি ছবিটি (বয়হুড) মুক্তি পেয়েছিল। আর তারও আগে, গত বছরের জানুয়ারিতে সানড্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হওয়ার পর থেকেই বহু প্রশংসা কুঁড়িয়েছে এটি। এখন অনুমানই সঠিক হয় না কি ‘অঘটন’ ঘটে, তা তো দেখার আছে!

এবার দেখা যাক, বেশ কিছু ক্যাটাগরিতে যাদের সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের নাম-

সেরা পার্শ্ব অভিনেতা : ‘হুইপল্যাশ’ এ জে কে সিমন্স- কারণ তিনি তেমনটাই করেছেন যা তিনি সচরাচর করেন!

সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী : ‘বয়হুড’ ছবির জন্য, অবশ্যই প্যাট্রিসিয়া অর্কেট! এমা স্টোন মনোনয়ন পেয়েছেন এটাও আমার বেশ ভালো লেগেছে।

সেরা ডকুমেন্টারি ফিচার : ‘সিটিজেন ফোর’ই জিতবে- এর অসামান্য গল্পকথনের জন্য।

সেরা বিদেশি ভাষার ছবি : দ্বিধা আছে। ‘টিম্বাকটু’, ‘আইডা’, ‘লেভায়াথান’, ‘ওয়াইল্ড টেলস’- আসলে ঠিক বলা যাচ্ছে না।

সেরা অ্যানিমেশন : একদম দারুণ একটা ক্যাটাগরি। আমি শুধু ট্রেলারগুলো দেখেছি। মনে হয় ‘বিগ হিরো ৬’!

সিনেম্যাটোগ্রাফি : রবার্ট ইওম্যানকেই এগিয়ে রাখতে চাই ‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’-এর জন্য, তবে জিতবেন শেষ পর্যন্ত ‘বার্ডম্যান’ দিয়ে ইমানুয়েল লুবেজকিই বাজিমাত করবেন।

চলচ্চিত্র সম্পাদনা : আমেরিকান স্নাইপার। দারুণ এডিটিং হয়েছে।

কস্টিউম ডিজাইন : মিলেনা ক্যানোনেরো (দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল)

রুপসজ্জা ও কেশসজ্জা- ফ্রান্সেস হ্যানন এবং মার্ক ক্যুলিয়ার (দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল)

সঙ্গীত (অরিজিনাল স্কোর)- আলেকজান্দার ডেসপ্লাট (দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল)

সঙ্গীত (অরিজিনাল গান)- গ্লোরি ( সেলমা)

প্রোডাকশন ডিজাইন- দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল

সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি : ডিজনির ‘ফিস্ট’।

সেরা প্রামাণ্যচিত্র (স্বল্পদৈর্ঘ্য) : ক্রাইসিস হটলাইন : ভেটেরানস প্রেস ১

সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি (লাইভ অ্যাকশন) : দ্য ফোন কল

সাউন্ড এডিটিং : আমেরিকান স্নাইপার

সাউন্ড মিক্সিং : বার্ডম্যান

ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস : ইন্টারস্টেলার

চিত্রনাট্য (অ্যাডাপ্টেড) : দ্য ইমিটেশন গেম

চিত্রনাট্য (অরিজিনাল) : দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল

রিচার্ড ব্রডি : দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় লেখালেখি করছেন ১৯৯৯ সাল থেকে। ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, জ্যঁ লুক গদার এবং স্যামুয়েল ফুলারের মতো বাঘা বাঘা পরিচালককে নিয়ে চালিয়েছেন কলম। নিউ ইয়র্কার ওয়েবসাইটটির জন্য লেখেন নিজের ব্লগেই; বিষয়- চলচ্চিত্র অবশ্যই! দুদিন বাদে, ২২ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ৮৭তম অস্কারে পুরস্কারগুলো কে বা কারা পেতে যাচ্ছেন তা নিয়ে করেছেন আদ্যোপান্ত যাচাই। নাতিদীর্ঘ বিশ্লেষণটি থেকে এই সংক্ষেপিত ভাষান্তরটি করেছেন সামি আল মেহেদী।