আহসান হাবীবের রম্য
ঢাকা আবারো ডুবেছে
ঢাকা শহর পানিতে ডুবে যাওয়া, এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। ঢাকা আবারো ডুবেছে। এক লোক ফোন দিল তার পরিচিতজনদের, বৃষ্টিতে কোথায় কতটা পানি জমল জানার জন্য।
—আমাদের এখানে হাঁটুপানি, তোদের ওখানে কী অবস্থা?
—আমাদের এখানে কোমরপানি।
এবার ওই লোক গুলশান এলাকার বড়লোক এক বন্ধুকে ফোন দিল।
—তোদের ওখানে পানি জমেছে নাকি?
—গলা পানি!
ওই এলাকায় গলা পানি হয় কী করে? ওই এলাকায় তো বৃষ্টিতে পানি জমার কথা না! পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বৃষ্টির দিনে তিনি ‘পানীয়’ পান করছেন ঘরে বসে। সেই ‘পানি’ গলা পর্যন্ত...মানে বেহেড মাতাল।
এ ধরনের জোক ঢাকা ডুবলেই শোনা যায়। আমার পরিচিত একজন রিকন্ডিশন গাড়ি কেনার জন্য ব্যস্ত হয়েছিলেন। তিনি হঠাৎ জানালেন, রিকন্ডিশন গাড়ি কেনার চিন্তা বাদ দিয়ে রিকন্ডিশন নৌকা খুঁজছেন সিরিয়াসলি! ঢাকা শহরে নৌকার কোনো শোরুম না থাকায় তিনি বিশেষ চিন্তিত এবং বিরক্ত!
কদিন আগে দেখলাম, বিজয় সরণির মোড়ে বিশাল ব্যানার, সেখানে লেখা ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন। বিলবোর্ড সংস্কৃতিকে রক্ষা করুন’। আমাদের মেয়ররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ঢাকা থেকে বিলবোর্ড সরানো হবে। কারণ, এগুলো ঢাকাকে ঢেকে ফেলেছে, দিগন্ত দেখা যায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও দিগন্ত ঢাকা পড়েছে বহু আগেই, বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্টের কারণে। যাহোক, মনে হচ্ছে মেয়ররা তাঁদের ঢাকা উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করেছেন উপর থেকে ‘টপ টু বটম’, হয়তো উপর থেকে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামবেন, মানে বৃষ্টির পানিতে এসে ঠেকবেন। সেটাই বা মন্দ কী!
তবে মুশকিল হচ্ছে কি, মেয়ররা কিন্তু কেউ রাজনৈতিক ব্যানার-ফেস্টুন, যা রাস্তাঘাটের মোড়ে মোড়ে ঝুলছে, এসব নিয়ে কথা বলছেন না; এগুলোর কোনো কোনোটা কিন্তু আবার বিলবোর্ডের চেয়েও বড়। এগুলো কি ঝুলতেই থাকবে? বিলবোর্ডের ছবি বা ডিজাইনগুলো কিন্তু আধুনিক দৃষ্টিনন্দন; কিন্তু রাজনৈতিক ব্যানার-ফেস্টুন বিলবোর্ডগুলো অরুচিকর, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
থাক এসব, এখন বরং মেয়র নিয়ে একটা গল্প শোনা যাক। এক গরিব দেশের মেয়র ঠিক করল, সে তার শহরটা ঠিক করবে। কীভাবে ঠিক করবে, সেটা বোঝার জন্য একদিন নিজের খরচে চলে গেল বিদেশের কোনো শহরে (ধরা যাক ইউরোপের কোনো আধুনিক শহরে)। সে একটা নোটবুক নিয়ে সারা শহর ঘুরে ঘুরে পয়েন্ট টুকল, কীভাবে এই শহর এত সুন্দর আছে বা থাকছে। এই জিনিসগুলোই সে তার নিজের শহরে ফিরে গিয়ে অ্যাপ্লাই করবে। দুই-তিন দিন থেকে সে যখন নোটবই নিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে গেল, তখন সে দেশের সিকিউরিটি তাকে আটকাল।
—কী ব্যাপার, আমাকে আটকালেন কেন?
—দেখি আপনার নোটবুকটা? কী নোট করে নিয়ে যাচ্ছেন?
—দেখুন, আমি আমার দেশের একজন সম্মানিত মেয়র। আমি আপনাদের শহরের ভালো ভালো কার্যক্রম নোট করে নিয়ে যাচ্ছি, এখানে আমার কী অপরাধ? আমি আমার দেশে গিয়ে এগুলো অ্যাপ্লাই করব। আমাদের শহর হয়ে উঠবে আপনাদের শহরের মতো আধুনিক আর সুন্দর।
—সেটা করুন, কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু আপনার পয়েন্টগুলো আমরা দেখতে চাই।
মেয়র নোটবই খুলে দেখাল। তারা পয়েন্টগুলো প্রত্যেকটা কপি করে নিল। তার পর নোটবুক ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে ধন্যবাদ, এখন যেতে পারেন...।’
মেয়র অবাক হয়ে বলল, ‘আপনারা আমার পয়েন্টগুলো নোট করলেন কেন?’
তারা হাসল। বলল, আপনি যে পয়েন্টগুলো নোট করলেন, এগুলো আমাদের ব্যাড পয়েন্ট। এগুলো ধরে ধরে আমাদের আরো উন্নয়ন করতে হবে শহরের, তাই আপনার পয়েন্টগুলো কপি করে নিলাম... আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
লেখক : গল্পকার ও ‘উন্মাদ’ পত্রিকার সম্পাদক