রম্য

বৃষ্টি নামুক আর নাই নামুক

Looks like you've blocked notifications!

আজ রবীন্দ্রনাথ যদি ঢাকায় আসতেন? খুব মজা হতো। নৌকায় করে সংসদ ভবনে যাওয়া যেত। জ্ঞানী মানুষ, পাবলিক লাইব্রেরিতে নিশ্চয় যেতেন? যেতেন শাহবাগেও। মিরপুর, আজিমপুর, উত্তরা, বাড্ডা...দুদণ্ড আড্ডা দিতে আরো অনেক জায়গায়ই যাওয়ার সাধ হতো কবিগুরুর। ভালোই হতো। একদিনে সারা ঢাকা শহর ঘুরিয়ে আনা যেত। নৌকায় তো আর ‘নৌজট’ বাঁধার সিস্টেম এখনো আবিষ্কার হয় নাই। মাঝি হিসেবে কে থাকত? কুবের মাঝি? মানিক সাহেব কি মাঝিকে ছুটি দিতেন? অবশ্যই দিতেন। কবিগুরুর সাধ বলে কথা। কুবের মাঝির সঙ্গে গুরুর কী ধরনের কথাবার্তা হতো?

 

গুরু—চারদিকে অথৈ জল, পাই না খুঁজে দিক
 কোনটা উত্তরের কোনটাই বা পুবের,
 মন খারাপ করে আছো কেন, ওহে মাঝি কুবের?

কুবের মাঝি—আর বলিবেন না দাদা

 সকালে খেতে বসে দেখি
 পরোটায় লেগেছে কাদা।

গুরু—ইশ! অতীব দুঃখের কথা

 ব্যবস্থা নাওনি যথা?
কুবের মাঝি—ব্যবস্থা কী নিবো গুরু,

 পরোটা বানিয়েছিল গিন্নি
 এ নিয়ে মুখ খুলিলে

নিজেকেই রাধিতে হইবে

নিজ কুলখানির শিরনি।

গুরু—তবে বুঝিলাম কষ্টে আছো বেশ!

কুবের—আমি আর কী এমন,

 বেশি কষ্টে আছে জনগণ,
                আরো কষ্টে দেশ।

গুরু—উপর থেকে ভাবিয়াছিলাম, কী দারুণ বর্ষা

 রোদহীন বঙ্গে ললনা হইবে
         ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ছাড়াই ফর্সা।

         মাছে ভাতে বাঙাল ফিরিয়া পাইবে মান
                শহর নগর সর্বদা, নির্বিঘ্নে মাছ চাষে

 সাহায্য করিতেছে বান।

কুবের—সে গুরু বেশ পারেন বলিতে

        একবার ভাবুন তো, কতটা কষ্ট

        সহ্য করতে হয় নগরবাসীর, চলিতে?

গুরু—প্রভাতে দেখিলাম জল ডিঙাইয়া, স্কুলে যাইতেছে ফুলের মতো শিশু

কুবের—কে জানে কত মল এ জলে, কতই বা মিশিছে হিশু।

গুরু—কি দুঃখ কি কষ্ট বঙ্গের আগে জানিনি তা
 আচ্ছা, এহেন জনদুর্ভোগ দেখিয়া
 কী করে ঘুমান দুই-দুইজন নগর পিতা?

কুবের—এবার কিন্তু গুরু ছাড়িতে হইবে দেশ
 উনারা যাহাই করুক বাজাইতে হইবে তালি
 দিতে হইবে বাহবা, বলিতে হইবে বেশ।
গুরু—কেন কেন? এ কেমন বাত!
 তবে যে ভোটের আগে, ঝাড়ু হাতে

 দেশ করিলেন মাত?

কুবের—সে তো গুরু ভোটের আগে
 একটু-আধটু সবাই করে
 গুরু—ভোটে জিতিলে সরিয়া পরে?
কুবের—তা ঠিক বলছি না, এখনো আছেন বেশ,
 দেখেন না, উন্নয়নের জোয়ারে ছলাত ছলাত ভাসিতেছে দেশ।

গুরু—চাহি না এই জোয়ার আমি, আনিয়া দাও ভাটা
 নইলে বাপু চেয়ার ছাড়, বলিয়া দাও টাটা।

কুবের—চেয়ারের মায়া বড় মায়া
 একবার যে জন পায়
 সহজে কি ছাড়িতে চায়?

গুরু—আহা, একি দেখিছিনু স্বপ্নে
 রঙ্গ রসের বঙ্গ আজি
 ডুবিতেছে অযত্নে।

 অথচ, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম

 আকাশে জমিলে মেঘ কাব্য লিখিতাম।

 কুবের—আমরা একটু বর্ষা হইলে গাড়ি ছেড়ে নৌকা ধরি,

 কারা যেন হাত নেড়ে ডাকিতেছে, থামাইব কি তরী?

গুরু—ওহে কুবের চিনিলে না, ও তো নজরুল ও জীবনানন্দ দাশ,
 কিহে নজরুল, আমাদের কাছে কি লিফট চাস?

নজরুল—গুরু ইউ আর রাইট,
 জীবন বাবু ম্যানহলে পরে

 তাঁর অবস্থা টাইট।

জীবনানন্দ—এক বালিকাকে মনে হইলো বনলতা সেন
 তাহার দিকে তাকাইতে গিয়াই খেয়াল করি নাই ড্রেন।

 

গুরু—চল চল, এখানে মোর হিয়া রহিবে না।
 এত কষ্ট এত দুঃখ এ দিলে আর সহিবে না।

নজরুল—বিদ্রোহী আমি রণক্লান্ত,
 পচা পানির গন্ধে আমার ফুসফুস আজ শান্ত।
 ওহে কুবের ঘোরা নাও
 যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলিয়া যাও।
জীবনানন্দ—গুরু ঐদিকে দেখুন চেয়ে
 শত শত মানুষ আমাদের দিকে

 কেন আসছে ধেয়ে!

নজরুল—চুপ কেন কুবের, বল এরা কারা
 কেন সবাই পুঁটলি হাতে, আমাদের করিতেছে তারা?

গুরু—ভয়ে দুরু দুরু কাঁপিতেছে বুক
 ফিরিয়া ঘরে দেখিতে কি পাইব আপন জনের মুখ?
কুবের—ওরা সবাই এই দেশের লোকজন
 জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়া যাবে, তাই খুঁজিতেছে ক্ষণ।

 আমাদের তরী মালয়েশিয়াগামী ভাবিয়া

 এই দিকে সবাই আসিতেছে ধাবিয়া।

 

একসঙ্গে অনেক মানুষ দৌড়ে এসে নৌকায় উঠতে শুরু করল। কুবের মাঝি হাজার চেষ্টা করেও কাউকে নামাতে পারল না। নজরুলের ধমক, জীবনানন্দ দাশের মিনতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিষেধ—কোনোটাই সাধারণ মানুষের কানে গেল না। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে একসময় নৌকায় পানি ওঠা শুরু করল। কবিগুরু ও জীবনানন্দ দাশকে তখন চিৎকার করে বলতে শোনা যাচ্ছিল—

 

‘ডুবাইয়া দিলি আমার সোনার তরী
 বৃষ্টি নামুক আর নাই নামুক

 আজ জলে ডুবিয়া মরি।’

 

লেখক : রম্য লেখক