আফগানদের কাছে ‘কাবুলিওয়াশ’ হলো টাইগাররা

Looks like you've blocked notifications!

ক্রিকেটেও রবীন্দ্র নাথকে উপেক্ষা করা যাচ্ছে না! দেরাদুনে যা ঘটল তাতে রবি ঠাকুর ঢুকে পড়লেন। সৌজন্যে আফগান ক্রিকেটাররা। তিন ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশকে তারা রীতিমত বিধস্ত করলো। তিনটা ম্যাচই জিতলো তারা। হোয়াইটওয়াশ, ব্রাউনওয়াশ, বাংলাওয়াশ এই সব শব্দের পর ক্রিকেট বিশ্ব নতুন এক শব্দের সাথে পরিচতি হলো। ‘কাবুলিওয়াশ’! হ্যাঁ, আফগানদের কাছে বাংলাদেশ কাবুলিওয়াশ-ই হলো। আর এই নতুন শব্দটার জন্য আফগানরা ধন্যবাদ জানাতে পারেন, নোবেলজয়ী রবীন্দ্র নাথকে। কারণ, উনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে সেই ১৮৯২ সালে বরীন্দ্র নাথ কাবুলিওয়ালা গল্পটা লিখেছিলেন। আর ঐ গল্পটা এই উপমহাদেশে আফগানদের যে ব্র্যান্ড দিয়েছিল, তা কী আর লক্ষ কোটির কোন বিজ্ঞাপণে আফগানরা পেয়েছে?  গত কয়েক দশক ধরে আফগানিস্তানের বিজ্ঞাপণ মানে যুদ্ধবিধস্ত এক দেশ। সন্ত্রাসকবলিত এক জনপদ। যেখানে বোমারু বিমানের শব্দের দিকে কানপেতে থাকতে হয় মানুষকে। বাতাসে মানুষ পায় বারুদের গন্ধ। সেখানকার আকাশে সূর্য ঢেকে যায় বারুদ, ধোঁয়া আর কামানের গোলায় ধসে যাওয়া বাড়ির ধুলোয়। সেই আফগানিস্তানের এক নতুন বিজ্ঞাপণের নাম হতে যাচ্ছে ক্রিকেট।

বছর তিনেক আগে আফনিস্তানের প্রেসিডেন্ট রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতে গিয়ে বলেছিলেন; ‘কাবুলিওয়ালার নুতন সংস্করণ লেখার সময় কিন্তু হয়ে গেছে।’ হ্যাঁ, আফগানিস্তানের ক্রিকেটাররা সেই সংস্করণ লিখতে শুরু করলেন। ভারতের মাটিতে আইপিএল খেলছেন কাবুলিওয়ালারা। ভারতে এখন তাদের ক্রিকেটের বসত। ভারত তাদের ক্রিকেটের বাজারও। সেই ভারতের মাটিতে আফগানিস্তান তিন ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশকে হারালো। রবীন্দ্র নাথ বেঁচে থাকলে আফগান ক্রিকেটেরাদের নিয়ে কী লিখতেন কেন জানে। তবে রবি ঠাকুরের রহমতের মতো একজন রাশিদ খান, মোহাম্মদ নবী, মুজিবুর রহমানরা আইপিএলের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হোন বা বাংলাদেশের বিপক্ষে প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ হোন তাদের কণ্ঠে কিন্তু বেরিয়ে আসে রহমতের গলার সেই সুর। সেই ফেলা আসা দেশের কথা। সেখানাকার মানুষ, পরিবার, পরিজনের কথাই তাঁরা বলে যান পুরস্কার হাতে নিয়ে টেলিভিশনের মাইক্রোফোনের সামনে। তাদের কথায় থাকে, দেশ আর দেশের মানুষ। সেখানে থাকে আক্ষেপও। নিজের দেশের মাটিতে ক্রিকেট খেলতে পারছেন না তারা। আক্ষেপ থাকাটা খুব স্বাভাবিক।

রবীন্দ্র নাথ কাবুলিওয়ালা লেখার পর গোটা বিশ্ব দেখেছে গোটা দুয়েক বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পৃথিবী কত পাল্টে গেছে। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্বে যুদ্ধ এখনো আফগানদের পিছু ছাড়েনি। জলপাই রঙের ট্যাংক, উর্দিপরা বিদেশিদের আনাগোনা এখনো আফগানিস্তানে। দুই পক্ষের বন্দুকের নলের মুখে শান্তি বন্ধক রাখতে হয় আফগানদের। তারা এখন শান্তি খোঁজে ক্রিকেটে। এক একটা জয় তাদের কাছে অন্যরকম এক একটা বার্তা নিয়ে হাজির হয়। আফগান ইতিহাস আর সংস্কৃতি বলে, তারা ঠিক লড়াইয়ের জাত নয়। কিন্তু ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে যে লড়াই করল তাতে কী মনে হয় না, পরিস্থিতি ওদের বদলে দিয়েছে। আফগান হাওয়া ছিল সুর আর কবিতার। কিন্তু যুদ্ধ সব কিছু পাল্টে দিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে শক্ত হয়েছে তাদের হাতের কব্জি। সেটা একজন মোহাম্মদ নবী, আসগরদের ব্যাটিং বারবার বলে দেয়। রাশিদ খান, মুজিবুর রহমানদের কব্জির মোচড় বুঝতে পারলেন না বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। যে কারণে ক্রিকেটপ্রেমী বাঙালির হৃদপিণ্ডটা বারবার খামছে ধরেছে। সিরিজের শেষ ম্যাচে রাশিদ খানের করা শেষ বলে আফগান ফিল্ডার শফিকউল্লাহ যেভাবে বাউন্ডারি বাঁচালেন, তাতে  হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম গোটা বাংলাদেশের হৃদপিণ্ড। আরিফ যেভাবে বলটাকে খেলেছিলেন, তাতে সেই বলের ঠিকানা তো ছিল বাউন্ডারি লাইনের ওপারে। কিন্তু একজন শফিকউল্লাহ যেভাবে প্রায় অতিমানবীয় দক্ষতায় নিজে মাঠের বাইরে গিয়েও বল ভেতরে রাখলেন, তার প্রশংসা না করা মানে সংকীর্ণতায় ভোগা। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়েও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেই হবে আফগানদের।

হ্যাঁ, আরিফ যেভাবে লং অন দিয়ে রাশিদ খানের বলটা খেলেছিলেন, তার চেয়ে বেশি কী করার ছিল কোন ব্যাটসম্যানের। কিন্তু একজন শফিকউল্ল্যাহ যা করলেন তাতেই এক রানে হার বাংলাদেশের। বাংলাদেশ হারলো। কিন্তু জিতলো ক্রিকেট। সত্যিই অসাধারণ এক ম্যাচ জিতেছে আফগানিস্তান। আর ঐ ম্যাচের ঐ এক রান ক্রিকেট লিখিয়েদের দিয়েও লিখিয়ে নিল ‘ কাবুলিওয়াশ’ শব্দটা। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ এখনো কাবুলিওয়ালাদের সেরা বিজ্ঞাপণের নির্মাতা।

হিংসার আবাহে, বারুদের গন্ধ ভাসা বাতাসে, যুদ্ধ বিধস্ত আফগানিস্তানের নয়া শান্তির বিজ্ঞাপণের নাম- ক্রিকেট। কলকাতায় রবি ঠাকুর খুঁজে পেয়েছিলেন রহমতকে। আর এ দেশের ক্রিকেটানুরাগীরা দেরাদুনে খুঁজে পেলেন রহমতের মতো অনেককে। তাদের কারো নাম রাশিদ খান, কারো নাম মোহাম্মদ নবী, কারো বা নাম মুজিবুর রহমান। যারা ক্রিকেটকে ভালবেসে চিনেছে জয় নামক শব্দটাকে। জয়, জয় আর জয় শেষে তারা মেতে উঠতেই পারেন ‘কাবুলিওয়াশ’-র আনন্দে।

দেশপ্রেমের আবেগে আপনি ভাসতে পারেন। আফগানদের কাছে হারে আপনি হতাশ হতে পারেন। ক্ষুব্ধ্ও হতে পারেন। তারপরও ক্রিকেটীয় উদারতায় প্রশংসা করতেই হবে কাবুলিওয়ালাদের। যোগ্যতা-দক্ষতা দিয়েই তারা বাংলাদেশকে কাবুলিওয়াশ করেছে।

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জানালিস্ট এবং কলাম লেখক।