কাপ যুদ্ধ

হারজিৎ দিয়ে ফুটবল জিনিয়াসদের বিচার!

Looks like you've blocked notifications!

রোনালদোর হ্যাটট্রিক। মেসির পেনাল্টি মিস! নেইমারের মাঠে নামার অপেক্ষা। বিশ্বকাপে নাটকীয়তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে প্রথম রাউন্ড মাঠে গড়াতে না গড়াতেই। কাপ যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই আবেগের এই রংধনু দেখে এই গ্রহের সবচেয়ে খুশি মানুষের নাম অবশ্যই ভ্লাদিমির পুতিন। কারণ, রাশিয়া এখন গোটা বিশ্বেও মন জয়ের কথা ভাবতেই পারে। সেটা ফুটবল আথিতেয়তায়। কিন্তু এক মাসের যুদ্ধ শেষে খুশি হবেন পৃথিবীর অনেক মানুষ। সেই তালিকায় উদ্বোধনী ম্যাচের হাসিমাখা পুতিনের মুখ খুঁজে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেদিক থেকে পুতিনকে না খোঁজাই ভালো। কিন্তু রোনালদো, মেসি, নেইমার, গ্রিজম্যান, ইনিয়েস্তা, ওজিল এদের কারো মুখ খুঁজে না পেলে তাকে কী বলবেন? হয়তো ছোট একটা শব্দ উচ্চারিত হবে ফুটবল বিশ্ব জুড়ে : ‘অঘটন।’ রাশিয়ায় অঘটন ঘটল। কিন্তু বিশ্বকাপের ইতিহাস আবার বড্ড বেশি ঐতিহ্যের পূজারি। কাপ জেতার অভ্যাস যাদের নেই তাদের হাতে ফুটবল ঈশ্বর কাপ তুলে দিতে একটু দ্বিধান্বিত থাকেন।

স্পেনের বিপক্ষে রোনালদো যা করে দেখালেন, তা নিয়ে ফুটবল বিশ্বে একটা আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। রোল-রোল- রোল রোনালদো! সি আর সেভেনকে নিয়ে রীতিমতো গলা সপ্তমে চড়িয়ে কোরাস গাইছেন তাঁর ভক্ত সমর্থকরা। রোনালদো বা পর্তুগাল ভক্ত যারা নন, তাদের মুখ থেকেও পর্তুগিজ অধিনায়ক একটা বাক্য বের করিয়ে নিয়েছেন গোটা তিনেক গোল করে। স্পেন-পর্তুগাল ম্যাচে ফুটবলের জয় হয়েছে। জয় হয়েছে রোনারদোর। হ্যাঁ, অসাধারণ এক ম্যাচ। সেই ম্যাচের স্কোর লাইনে যতই লেখা থাকুক স্পেন-৩, পর্তুগাল-৩। আসলে অদৃশ্য স্কোর লাইনটা হচ্ছে রোনালদো -৩, স্পেন- ৩! গোটা ম্যাচ যতই তিকি-তাকার ছন্দে স্পেনময় হোক না কেন, ম্যাচ শেষে সেই ম্যাচের ট্যাগ লাইন পাল্টে আপনাকে লিখতেই হবে রোনালদোময় এক ম্যাচ। রামধনূর মতো বাঁকানো আর রাঙানো যে শট বেরিয়ে এলো ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পা থেকে, এক মুহূর্তের জন্য হলেও চোখের জন্য স্বস্তিদায়ক, তৃপ্তিদায়ক। এর চেয়ে ভালো রঙিন দৃশ্য বিশ্বকাপে খুব কমই হয়!

অন্যদিকে, ভিন্ন গ্রহ থেকে ফুটবল ঈশ্বর যাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন ফুটবলানুরাগীদের হৃদয়ে জমে থাকা ভালোবাসা উজাড় করে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সেই তিনি প্রথম ম্যাচেই আটকে গেলেন বরফ জমে থাকা এক দেশ থেকে আসা ফুটবলারদের কাছে! যে দেশটা বরফে আচ্ছন্ন থাকে বেশির ভাগ সময় তারাই কি না আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বুকে বরফের চেয়েও ভারি কিছু একটা জমিয়ে দিয়ে গেলেন! তার নাম হতাশা! ফুটবল ঈশ্বর বিশ্বকাপের শেষ দৃশ্যের চিত্রনাট্য কী লিখে রেখেছেন সেটা কেউ জানেন না। কিন্তু আইসল্যান্ডের এক চিত্রপরিচালক কিন্তু আর্জেন্টিনা-আইসল্যান্ড ম্যাচে সত্যিই এক চরিত্র হয়ে গেলেন। ফুটবল জাদুকরের জাদুকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন।  গোল পোস্টে দাঁড়িয়ে আটকে দিলেন লিওনেল মেসি পেনাল্টি কিক। তার সামনে হতাশার মৃর্তি হয়ে গেলেন ফুটবল জাদুকর নিজে। মেসির পেনাল্টি মিস। আর্জেন্টিনার জয় হাতছাড়া।

ফুটবল বিশ্বে শিরোনাম হিসেবে ঝড় তুলতে বাড়তি আর কোনো কিছুর দরকার পড়ে কি! দাঁড়িতে ঢাকা শিশুসুলভ মুখেও হতাশা আর বিষাদের ছায়া দেখলো ফুটবল বিশ্ব। চারিদিকে মেসিভক্তদের হতাশা এত করুণরাগে বেজে উঠেছে, বিশ্বকাপ ইতিহাসে যেন কেউ কোনোদিন পেনাল্টি মিস করেননি! মেসিই বোধহয় প্রথম মিস করলেন! কিন্তু ভদ্রলোকের নামটা কিন্তু লিওনেল মেসি। ফুটবল ঈশ্বর যাকে বাড়তি কিছু দিয়েই এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পরের ম্যাচে তিনি জ্বলে উঠবেন না সেটা ভাবলে ভুল হতে পারে। শুধু পরের ম্যাচ কেন বলছি, বাকি বিশ্বকাপে ফুটবল ঈশ্বরের আরেক রূপ হয়ে যেতেই পারেন এল এম টেন।

মেসি-রোনালদোর দুই রকম অুনভূতি আর তাঁদের নিয়ে ফুটবল অনুরাগীদের উচ্ছ্বাস আর আকুতি খুব তাড়াতাড়ি দেখে ফেলেছে ফুটবল বিশ্ব। কিন্তু আরেকজন মাঠে নামার অপেক্ষায়। তার ওপর থাকছে আবার পেলে-গারিঞ্চা-রোমারিও-রোনালদো-রিভালদোদের কাপের বোঝা! ব্রাজিলিয়ানদের কাপ জয়ের সংখ্যাটা পাঁচ থেকে ছয় করার দায়িত্ব নেইমারের কাঁধে। ভাঙা পা, ক্র্যাচে ভর দিয়ে বিশ্বকাপের আগে বেশিরভাগ সময় কাটল যার সেই নেইমারকে ঘিরেই ব্রাজিলিয়ানরা স্বপ্ন দেখছেন, মস্কো থেকে কাপ নিয়ে রিও ডি জেনেরিওতে পা রাখবে তারা। নেইমার জ্বলে উঠলে ব্রাজিলিয়ানদের সেই স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকবে না। সেটাই বাস্তব হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর উপরি পাওনা হতে পারে ২০১৪ তে মারাকানায় জামার্নদের কাছে ৭-১ গোলে বিধ্বস্থ হওয়ার হতাশা ভুলে যাওয়া।

মেসি-রোনালদো-নেইমার। এই তিন মূর্তিকে ঘিরেই ফুটবল বিশ্বের আবেগ ঘুরপাক খাবে। অন্তত তাঁরা যতক্ষণ বিশ্বকাপে আছেন। এরা আবার ১৫ জুলাই পর্যন্ত থাকতে পারবেন সেই গ্যারান্টিও নেই। সেটা কেউ দিতে পারছেন না। তবে এরা ফুটবল জিনিয়াস। সেই গ্যারান্টি অন্য কারো কাছ থেকে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। আর ফুটবল মাঠের জিনিয়াসদের একটা পেনাল্টি মিস, একটা দুর্দান্ত গোল, কিংবা একটা বিশ্বকাপ জয় দিয়ে বিচার করা ঠিক নয়। মেসি একটা বিশ্বকাপ না জিতলেই কি আপনি ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের গ্রেটদের তালিকা থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলতে পারবেন! সম্ভব না। অনেকেই বিশ্বকাপ জিতেছেন। কিন্তু তাদের কজনকে ফুটবল ইতিহাস বুকের মাঝে ধরে রেখেছে! আবার হুয়ান ক্রুয়েফের মতো ফুটবলার যিনি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন কিন্তু  কাপ জিততে পারেননি। তাঁকে কি গ্রেটদের তালিকা থেকে সরিয়ে রাখতে পারছেন? রাখতে গেলে অন্তত বার কয়েক আপনাকে ভাবতেই হবে। কারণ, ফুটবল ইতিহাস তাঁকে খুব সযত্নে বুকে আগলে রেখেছে।

কাপ যার হাতেউ উঠুক, ফুটবল অনুরাগী হিসেবে এই প্রজন্ম খুব ভাগ্যবান। একই সময়ের এমন কয়েকজন ফুটবলারকে তারা দেখছেন এবারের বিশ্বকাপে, যাদের নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়। মেসি-রোনালদো-নেইমার। এরা প্রায় একই প্রজন্মের। এদের কাকে এগিয়ে রাখবেন? কার নামটা আগে উচ্চারণ করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। তবে একটা কাপ জয় বা হার দিয়ে এদের ফুটবল প্রতিভা মাপতে গেলে ভুল হবে। সেই ভুলটা না করাই ভালো।

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক