বিশ্বকাপ রঙ্গ

মিস পেনাল্টি, শিশু অভিনেতা ও মাইনাস টু

Looks like you've blocked notifications!

স্বর্গ আর নরকের মধ্যে ফুটবল খেলা হবে। স্বর্গের মানুষ খুশিতে আত্মহারা। কারণ, সব ভালো ফুটবলারই নাকি স্বর্গে আছেন। খেলা শুরু হওয়ার পর দেখা গেল, নরকের লোকরা নাচানাচি বেশি করছে! কী ব্যাপার? স্বর্গের লোকরা জানতে পারল, রেফারিদের কেউ স্বর্গে ছিল না। তাদের ঠাঁই হয়েছিল নরকে!

সবাই এমন ধারণা পোষণ করতে চান যে রেফারিরা নিরপেক্ষ থাকুক। ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপে সেটা ঘটেনি। ইতালি সেবার বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল এবং তখন ইতালি শাসন করতেন স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনি। তিনি নাকি যাচাই-বাছাই করে রেফারি নিয়োগ দিয়েছিলেন। ফলাফল ইতালি চ্যাম্পিয়ন!

যাই হোক, পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নাকি নিরপেক্ষ নন। অবশ্য নিরপেক্ষতার অন্য রকম একটা ‘নিরপেক্ষ’ সংজ্ঞা আছে। যেমন—১৯৭১ সালে যাঁরা মুক্তিযদ্ধের পক্ষে ছিলেন, তাঁরাই প্রকৃতপক্ষে নিরপেক্ষ ছিলেন। ১৯৯০ সালে যাঁরা স্বৈরাচার এরশাদের বিপক্ষে ছিলেন, তাঁরাই নিরপেক্ষ ছিলেন! বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলছে না বলে কোনো সমষ্টিগত স্বার্থ না থাকলেও যখনই কেউ ফুটবল নিয়ে লেখেন, অজান্তেই তাঁর সমর্থন চলে যায় তাঁর ভালো লাগা দলের প্রতি। ম্যারাডোনা যখন হাত দিয়ে গোল করেন, তখন কেউ কেউ কাব্য করে বলেন ঈশ্বরের হাত! আর পেলের তুলনা পেলে নিজেই। ফুটবলের কারণে তাঁর নামটাই বদলে গেছে! বাংলাদেশে ফুটবল উন্মাদনা এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একসঙ্গে পেলে আর ম্যারাডোনাকে ভালোবাসা যাবে না! নেইমার আর মেসিকে তুলনা করা কিংবা দুজনকে ভালোবাসা যাবে না। আপনাকে বেছে নিতে হবে যেকোনো এক দলকে! সমর্থনের প্রশ্নে বাংলাদেশটা আসলে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মতো ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনায় ভাগাভাগি হয়ে আছে!

বিশ্বকাপের শুরু থেকেই এমন ভাগাভাগি ছিল। ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দুই ফাইনালিস্ট দল ছিল উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা। তখন অফিশিয়াল ফুটবল বলে কিছু ছিল না। তাই কোন ফুটবল দিয়ে খেলা হবে, সেটা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। সমাধান হয় এভাবে, ফার্স্ট হাফ খেলা হবে আর্জেন্টিনার বল দিয়ে আর সেকেন্ড হাফ খেলা হবে উরুগুয়ের আনা বল দিয়ে! আর্জেন্টিনা তাদের বল দিয়ে ফার্স্ট হাফে দুই গোল দিতে পেরেছিল। আর সেকেন্ড হাফে উরুগুয়ে তাদের বল দিয়ে চার গোল দিয়ে ফেলে! এই বিশ্বকাপে নয়টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং ইউরোপের যে দলগুলো অংশ নেয়, জাহাজে করে তাদের উরুগুয়েতে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল চৌদ্দ দিন। ২০১৮ সালে বিমানে করে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ রাশিয়ায় যেতে সর্বোচ্চ সময় লাগতে পারে মাত্র ১৮ ঘণ্টা!

আয়োজকরা ঘরের মাঠে ফুটবল খেলে বলে অনেক সুবিধা পায়। নিজদেশের মাঠে ফুটবল আয়োজন করে ফ্রান্স যেমন চ্যাম্পিয়ন (এ তালিকায় ইতালিও আছে) হয়েছে, ঠিক তেমনি ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম পর্বই পার হতে পারেনি। ফ্রান্স কিংবা ইতালি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের বিশ্বকাপে প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে। ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনা ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত ‘ঈশ্বরের হাতে’র কৃপায় চ্যাম্পিয়ন হলেও ১৯৯০ সালে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই হেরে যায় বিশ্বকাপে একবারেই নতুন ক্যামেরুনের কাছে। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় বিশ্বকাপ হচ্ছে, এই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্যামেরুনের রজার মিলা সর্বোচ্চ বেশি বয়সে গোল করেছিলেন। রজার মিলার বয়স ছিল তখন ৪২ বছর! বিশ্বকাপের ইতিহাসে রজার মিলার মতো মজার নাচ সম্ভবত আর কেউ দেখাতে পারেননি! ২০১৪-এর বিশ্বকাপে নিজ দেশের মাঠে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হেরে (৭-১) বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েছিল ব্রাজিল। জার্মানির কাছে এই ‘সেভেন আপ’ পরাজয় নিয়ে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের অনেক আনন্দগাথা আছে। তবে ব্রাজিলের এমন দুঃখ আগেও ছিল। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েও ফাইনালে হেরেছিল উরুগুয়ের কাছে। সমর্থকদের কয়েকজন স্টেডিয়ামের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল!

আরো দুঃখ আছে বিশ্বকাপের প্রথম ট্রফি (জুলে রিমে ট্রফি) নিয়ে! দু-দুবার সেটা চুরি হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে প্রথমবার উদ্ধার করা সম্ভব হলেও দ্বিতীয়বার চুরির পরে সেটি আর পাওয়া যায়নি। ১৯৮৩ সালের পরে এই ট্রফির অস্তিত্ব শুধু ছবি কিংবা ভিডিওতে আছে। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, এই চোরকে বলা যেতে পারে ‘এলেমদার চোর’। তবে চুরির ঘটনা বিশ্বকাপে আরো ঘটেছে। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দলের ক্যাপ্টেন ববি মুর গ্রেপ্তার হন চুরির দায়ে! এই বিশ্বকাপে মাতলামির ঘটনাও ঘটেছিল। আর্জেন্টিনার মহাতারকা ম্যারাডোনার মাদক গ্রহণের ঘটনা কমবেশি সবাই জানেন। ১৯৯১ সালে মাদক গ্রহণের জন্য ১৫ মাস নিষিদ্ধ ছিলেন। ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপে দুই ম্যাচ খেলার পর আবারও ডোপ টেস্টে ধরা পড়েন, দল থেকে বহিষ্কৃত হন। বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার বিশাল সমর্থক দল গড়ে উঠেছে এই ম্যারাডোনার কারণে। জীবনযাপন, সমর্থন কিংবা ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের বিচার করে অনেকেই বলে থাকেন ম্যারাডোনা নিজেই এক মাদকের নাম! তবে ১৯৭০-এর বিশ্বকাপে ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল ও আর্জেন্টিনার মতো দল চূড়ান্ত পর্বে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিল।

১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ দুই কারণে বিখ্যাত। এ বছরই জার্সিতে প্রথম নম্বর বসানো হয়। এই বছরই প্রথম টেলিভিশনে খেলা দেখানো হয়, যা আজও অব্যাহত আছে। আর ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপ ছিল অন্য রকম কেলেঙ্কারিতে ভরা। চিলি আর ইতালির ম্যাচে তুমুল মারামারি শুরু হয়, যা গ্যালারিতেও ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এর পরে লাল আর হলুদ কার্ডের প্রচলন শুরু হয় বিশ্বকাপে! তবে ইংল্যান্ডের সমর্থকদের গুণ্ডামির রেকর্ড আছে। কোরিয়া ও জাপান যেবার বিশ্বকাপ আয়োজন করে, সেবার অনেক ইংরেজ গুণ্ডাদের ভিসা দেওয়া হয়নি। রাশিয়াও এই ইংরেজ গুণ্ডাদের নিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করেছে। ক্রিকেটের থার্ড বা ক্যামেরা আম্পায়ারিংয়ের মতো ফুটবলেও এমন রেফারিং শুরু হয়েছে ২০১৮-এর বিশ্বকাপে। খেলোয়াড়রা চাইলে রেফারি অবশ্যই সেটা বিবেচনা করে দেখবেন।

লেখাটা শুরু করেছিলাম বিশ্বকাপ উন্মাদনা তথা এ দেশের ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের উল্টাপাল্টা কর্মকাণ্ড নিয়ে। আইসল্যান্ডের জনসংখ্যা মাত্র তিন লাখ। তারা বিশ্বকাপের খুব ভালো দল। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা প্রায় পৌনে দুইশ কোটি বা তারও বেশি! এই দেশগুলো বিশ্বকাপে কখনো খেলতে পারবে কি না সন্দেহ রয়েছে। ভারত অবশ্য ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে একবার নাকি সুযোগ পেয়েছিল। (এ সময়ে বাছাইপর্ব বলে কিছু ছিল না) তাদের আবদার ছিল খালি পায়ে ফুটবল খেলার। ফিফা নাকি সেটার অনুমতি দেয়নি। যাই হোক, আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল সমর্থকদের উন্মাদনা দিন দিন বাড়ছে বলেই মনে হয়। ফেসবুকে এখন ‘৩২’ সংখ্যাটা জনপ্রিয়। কারণ ৩২ বছর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জেতেনি। কেউ কেউ আর্জেন্টিনাকে লিখছেন, ‘আরজেতেনা’ নামে! একজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ৩২ বছর আগে আর্জেন্টিনা হ্যান্ডবল টিম তাদের মাদক সম্রাট ম্যারাডোনার হাতের জাদুতে বিশ্বকাপ জিতেছিল। এরপর হাতও নেই, কাপও নেই! অন্যদিকে আর্জেন্টিনার সমর্থকরা বিখ্যাত করেছেন ১৬ শব্দটিকে। কারণ ব্রাজিল গত ১৬ বছরে বিশ্বকাপ জেতেনি। আর ব্রাজিলকে তারা ডাকছেন সংক্ষিপ্ত রূপে! টেলিভিশনে খেলা দেখানোর সময়ে স্কোর বক্সে যা লেখা থাকে আর কী! তারা ব্রাজিলের নেইমারকে শিশু এবং অভিনেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর ব্রাজিলের সমর্থকরা পেনাল্টি শট মিসের পর লিওনেল মেসির নাম দিয়েছেন মিস পেনাল্টি! সুন্দরীদের আদলে মেসির ছবিও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। তবে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম পেনাল্টি মিস করেছিলেন ব্রাজিলের ডি ব্রিটো!

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একবার ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা খুব আলোচিত হয়েছিল। যাঁরা এই মাইনাস টুর রূপকার ছিলেন, তাঁরা নিজেরাই দেশ ও রাজনীতি থেকে মাইনাস হয়ে গিয়েছেন, শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াই থেকে গেছেন দেশ ও রাজনীতির সঙ্গে। আর্জেন্টনা আর ব্রাজিল সমর্থকদের কাণ্ড-কারখানা দেখে কারো কারো মনে মাইনাস টু ফর্মুলার ‘ভাব’ জেগে উঠতে পারে। এই ভাব থেকেই হয়তো জার্মানি, পর্তুগালের সমর্থকদের সংখ্যা বাড়ছে দেশে। যাই ঘটুক, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকরা হয়তো আরো ১৬ বা ৩২ বছর অপেক্ষা করবে কাঙ্ক্ষিত শিরোপার জন্য! সমর্থক সম্ভবত এমনই হয়। ম্যারাডোনা নেই, কাপ জেতার নাম নেই, তবু আর্জেন্টিনার সমর্থকের অভাব হয়তো কখনো হবে না! ব্রাজিলও থেকে যাবে ফুটবল ঐতিহ্যের বাহক হিসেবেই।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : মনোবিজ্ঞানের ক্লাস নিচ্ছেন স্যার। তিনি জানতে চাইলেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে—ধর, একজন মানুষ সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কত কিছু যে বলছে আর হাত পা ছুড়ছে। ক্লান্ত হলে সামান্য সময়ের জন্য বেঞ্চিতে এসে বসছে। পরক্ষণেই একে ওকে ডাকাডাকি করে কত কিছু যে বলছে। বল তো লোকটা কে হতে পারে? এক ছাত্রী উত্তর দিল, স্যার লোকটা নির্ঘাৎ ফুটবল দলের কোচ!

লেখক : কলামিস্ট ও রম্য লেখক।