কাপ যুদ্ধ

বিশ্বকাপের বড় বিজ্ঞাপন ‘পতনশীল’ নেইমার!

Looks like you've blocked notifications!

‘পতনশীল’ নেইমার কি তাহলে হয়ে দাঁড়াচ্ছেন রাশিয়া বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন? ধাক্কা লাগলেই পড়ে যাচ্ছেন ব্রাজিলিয়ান এই তারকা! সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংবাদমাধ্যম সব জায়গায় এখন নেইমার চর্চা! সেটা গলির মুদির দোকানদার থেকে করপোরেট অফিসের বড়কর্তা। চায়ের আড্ডা থেকে টেলিভিশনের টক শো। সব জায়গায়। আট থেকে আশি সব বয়সী মানুষের মুখে এখন পড়ে যাওয়া নেইমার নিয়ে চর্চা!

সেটা শুধু এই বাংলাদেশে নয়। গোটা ফুটবলবিশ্বেই চলছে নেইমার-আলোচনা। নেইমার সমর্থক থেকে নেইমারবিরোধী সবার আলোচনার বিষয় নেইমার কেন পড়ছেন? পতনশীল নেইমার চর্চায় কে নেই? বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক থেকে বিশ্বকাপ জিততে না পারার হতাশা বুকে চেপে জীবনের বাকি কটা দিন পার করার অপেক্ষায় থাকা অনেক সাবেক তারকা ফুটবলার আছেন এই তালিকায়। প্রাক্তন তারকা, মহাতারকার অনেকেই ‘পতনশীল’ এই নেইমার নিয়ে অনেক মন্তব্য করছেন। কেউ বলছেন এটা তাঁর পেলে অ্যাক্টিং! কেউ সেটা দেখে বিস্মিত হচ্ছেন। কেউ বিরক্ত হচ্ছেন। কেউ আবার নেইমারের হয়ে যুক্তি দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, ‘একজন ফুটবলারকে আটকাতে গিয়ে যদি বারবার ফাউল করা হয়, সে পড়বে নাকি দাঁড়িয়ে থাকব?’

নেইমার চর্চার এই তালিকায় কে নেই? জার্মানির বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক লোথার ম্যাথুস থেকে ইংল্যান্ডের সাবেক তারকা অ্যালেন শিয়েরার। ব্রাজিলের বড় রোনালদো থেকে ফ্রান্সের অ্যাঁরিক কাঁতোয়া। বাদ যাচ্ছেন না কেউ। তবে বিস্ময়করভাবে একজন কিন্তু একেবারে নিশ্চুপ! বিশ্বকাপ এলে  যিনি সবকিছু নিয়ে সমালোচনায় মুখর থাকেন, সেই আর্জেন্টাইন মহাতারকা ডিয়েগো ম্যারাডোনা এখন পর্যন্ত বিস্ময়কর নীরবতা পালন করে চলেছেন! তবে তিনি আছেন তাঁর মতই। ইংল্যান্ডের কাছে কলম্বিয়ার হার সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘কলম্বিয়া হারল ঈশ্বরের হাতে!’ এই ঈশ্বর অবশ্য রেফারি। ‘হ্যান্ড অব রেফারি’ কলম্বিয়ার হারের কারণ। হ্যারি কেন যে পেনাল্টি থেকে গোল পেয়েছেন, সেটা রেফারির দেওয়া। ম্যারাডোনার প্রশ্ন, তিনি কেন ‘ভার’ (VAR)-এর সাহায্য নিলেন না! এত কিছু যাকে বলতে হচ্ছে তিনি হয়তো নেইমার চর্চার সময় বের করতে পারছেন না! অথবা আরো একটা কারণ হতে পারে, ‘পেলে অ্যাক্টিং’টা নেইমারের আগেই শুরু করেছিলেন ম্যারাডোনা।

ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে ’৯০-এর বিশ্বকাপে বিতর্কিত পেনাল্টিতে ফাইনালে হারিয়েছিল যার দল, সেই জার্মান অধিনায়ক লোথার ম্যাথুস অবশ্য সোজাসাপ্টা বলেছেন, ‘নেইমার অনেক বড় ফুটবলার। ওর এসব করার দরকার নেই।’ জবাব এসেছে নেইমারের স্বদেশি আরেক বিশ্বকাপজয়ী গ্রেটের মুখ থেকে। রোনারদো উত্তর, ‘ওকে যেভাবে ফাউল করা হচ্ছে, আঘাত পেলে পড়বে না তো কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাবে? বল ছাড়াও নেইমারকে ফাউল করা হয়েছে। রেফারির উচিত আরো কঠোর হওয়া এই ব্যাপারগুলোতে।’ রোনালদোর একসময়ের টিমমেট রবার্তো কার্লোস, লম্বা থ্রো আর দুর্দান্ত ফ্রি কিকের জন্য যিনি বিখ্যাত ছিলেন, তিনি কিন্তু ছোট্ট একটা মন্তব্য করেছেন। নেইমার চর্চা নিয়ে সময় নষ্ট না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর লেখা কলামে কার্লোস লিখেছেন, ‘সবাই নেইমার, নেইমার নিয়ে চিৎকার করছে। ওরা কি দেখছে না ফিলিপে কুতিনহো নামের একটা ছেলে কী দুর্দান্ত খেলছে! দারুণ  দারুণ সব শট নিচ্ছে গোলে। ম্যাচ জেতাচ্ছে! ব্রাজিল দলটাই ভালো ফুটবল খেলছে।’

তবে হ্যাঁ, নেইমারের এই ‘অভিনয়’ যতই বিস্মিত বা বিরক্ত হন না কেন লোথার ম্যাথুস, তিনিও কিন্তু নেইমারের হাতে কাপ দেখতে পাচ্ছেন। বিশ্বকাপজয়ী জার্মান অধিনায়কের মন্তব্য, ‘দল হিসেবে দারুণ ব্যালান্সড ব্রাজিল। ওদের অ্যাটাক আর ডিফেন্সের মাঝে ব্যালান্সটা খুব ভালো। বিশ্বকাপ শুরুর আগেও আমার ফেভারিট দল ছিল ব্রাজিল। এখনো তাই।’ ফেসবুক, টুইটারে নেইমারের পড়ে যাওয়ার ভিডিওতে ভরে যাচ্ছে। পতনশীল নেইমার নিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বিজ্ঞাপন। তবে এই নেইমারকে ঘিরেই কাপ জয়ের স্বপ্নটা আরো বেশি উজ্জ্বল হচ্ছে ব্রাজিলের। সেটা তাঁর ফুটবলীয় দক্ষতায়। পতনশীল এই নেইমারকে ধরে কাপ হাতে নিয়ে যদি ব্রাজিলিয়ানরা মস্কোতে চিৎকার করতে শুরু করেন ১৫ জুলাই ‘উই আর দ্য চ্যাম্পিয়ন’, তাহলে খুব বিস্মিত বা বিরক্ত হওয়ার কিছু থাকবে না। আর কাপ না জিতে দেশে ফিরলে হয়তো হতাশার অন্ধকারে ডুববে ব্রাজিল, বাংলাদেশের অনেক এলাকা!

তবে ৫২ বছরের অন্ধকারকে পেছনে ফেলে কাপটাকে দেখতে শুরু করেছে ইংলিশরা। সেটা হ্যারি কেনের আলোয়। ইংল্যান্ড অধিনায়কের পারফরম্যান্সে কাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছেন ইংলিশরা। টটেনহ্যামের এই ফরোয়ার্ডকে এখন ইংলিশরা বলতে শুরু করেছেন, ‘এইচ কে নাইন’! হ্যারি কেন জ্বলে উঠলে ইংলিশদের মুখের ছবি আরো উজ্জ্বল দেখাতে পারে ১৫ জুলাই। এখন পর্যন্ত তাঁর যা পারফরম্যান্স, তাতে অনেকের স্মৃতিতে ভেসে উঠছে ’৬৬-তে ব্রিটেনের রানির হাত থেকে ববি মুরের কাপ নেওয়ার ছবি। তবে পতনশীল নেইমারের বাতাস লেগে আগেভাগে যাতে হ্যারি কেন নিভে না যায়, তার জন্য তার জন্য  ইংল্যান্ড ম্যানেজার সাউথগেট বেলজিয়ামের বিপক্ষে তাঁকে মাঠেই নামাননি। উদ্দেশ্য, ফাইনালের আগে ব্রাজিল-ফ্রান্স-আর্জেন্টিনার সঙ্গে দেখা যাওয়ার গেটগুলো বন্ধ রাখা!

তবে রাশিয়া বিশ্বকাপের সিরিজ অব ফাইনাল তো শুরু হয়ে যাচ্ছে। কাপ জিততে হলে যেকোনো দলকেই কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল, ফাইনাল জিততে হবে। পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়িয়ে নেইমার কি পারবেন ব্রাজিলকে তিনটা ম্যাচ জেতাতে? নাকি হ্যারি কেন ‘এইচ কে নাইন’ ব্র্যান্ডের  হাজার ওয়াটের আলো ছড়াতে ছড়াতে নিয়ে যাবেন ইংলিশদের ফাইনালের পথে। ৫২ বছর ধরে যে পথটা খুঁজে পাচ্ছে না ইংলিশরা। নাকি গতিঝড়ে পতনশীল নেইমারকে ছিটকে দিয়ে, হ্যারি কেন নিভিয়ে দিয়ে, দেশমের  ডেম্বেলে, এমবাপেরা লেনিনের দেশে ফরাসি বিপ্লব ঘটাবেন। সব বিপ্লবের ঝাণ্ডা নামিয়ে দিয়ে লুইস সুয়ারেজ কাপটা নিয়ে যাবেন নাকি বিশ্বকাপের সেই আঁতুড়ঘর উরুগুয়েতে?

লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।