এক্সট্রা কাভার

অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের পুরোনো সমীকরণ!

Looks like you've blocked notifications!

অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। আবার অধিনায়ক হিসেবে অস্ট্রেলিয়াকে গত শতাব্দীর শেষ বিশ্বকাপটাও এনে দিয়েছেন। নিজে সব সময় রান করেছেন। আবার অধিনায়ক হিসেবে টিমটাকে নানাভাবে এক করেছেন! সম্ভবত একটু ভুল বলা হলো। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে সাফল্যের নিরীক্ষে অনেক প্রভাবশালী হওয়ার পরও ব্যাটসম্যান কিংবা অধিনায়ক—কোনোভাবেই সবার কাছ থেকে প্রাপ্য আনুগত্যটুকু পাননি! তবে বাকি বিশ্ব স্টিভ ওয়াহকে ভদ্র, চিন্তামনস্ক, সফল ক্রিকেটারই মনে করে। তবে সমস্যা তাঁর নিজের দেশ, নিজের টিমমেট আর সাবেক দু-একজন অধিনায়ক।

নিজের টিমের সব খেলোয়াড়ের প্রশ্নাতীত আনুগত্য স্টিভ পাননি। যদিও তাঁর দল ছিল বিশ্বজয়ী। প্রায় অপ্রতিরোধ্য! তবে ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠিত করার পরও সাবেকদের কাছ থেকে প্রাপ্য মর্যাদাটা তিনি পাননি! এমনকি তাঁর অন্যতম সৈনিক শেন ওয়ার্ন নেতা হিসেবে তাঁকে কখনো যথেষ্ট সমীহের চোখে দেখেননি। দেখতে চাননি; বরং তিনি এগিয়ে রেখেছেন অ্যালান বোর্ডারের মতো নেতাকে। কথা বলেছেন ইয়ান চ্যাপেলের সুরে। যার সারমর্ম দাঁড়ায়, ‘ও কোনো ক্যাপ্টেন নয়!’ ক্যাপ্টেন্সির প্রশংসা না হয় পরের ব্যাপার। কিন্তু শেন ওয়ার্ন যে স্টিভকে গত ২৫ বছরের সেরা অস্ট্রেলিয়া দলে একটা জায়গা পাওয়ারও যোগ্য মনে করছেন না! সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে ওয়ার্নের চোখে ২৫ বছরের সেরা যে ওয়ানডে দল বেরিয়েছে, সেখানে নেই তাঁর বিশ্বকাপজয়ী ক্যাপ্টেন স্টিভ ওয়াহ এবং অস্ট্রেলিয়ার সর্বশেষ বিশ্বকাপজয়ী ক্যাপ্টেন মাইকেল ক্লার্ক। এ দুজনকে পেছনে ফেলে দলে ঢুকে পড়েছেন মাইক হাসি!

সত্যিই কি ব্যাটসম্যান হিসেবে মাইক হাসি স্টিভ ওয়াহ ও মাইকেল ক্লার্কের আগে আসেন! হয়তো আসেন। কারণ, নামটা বসিয়েছেন শেন ওয়ার্ন। যাঁকে অনেক সাবেক অধিনায়ক মনে করেন, চিন্তাভাবনার দিক থেকে অনেক মৌলিক। তবে ওয়ার্নের ওই একাদশ আলোর মুখ দেখার পর সত্যিই একটা মৌলিক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্টিভ ওয়াহর দল বিশ্বজয়ী হলে কী হবে, সেই দলে নিশ্চয়ই অনেক অশান্তি লুকিয়ে ছিল, যার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এখন। স্টিভ বিশ্বকাপ জিতেছেন। বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। নিজে রান করে দিয়েছেন নিয়মিত। ৫৭ টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে ৪১ টেস্টে জিতেছেন। কিন্তু পরিসংখ্যানের এই সাফল্য মোটেও যথেষ্ট নয় বলেই অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট-সমাজে স্টিভের নিরঙ্কুশ গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নটা জাগছে। অথচ দলটায় তিনি অনেক নতুন চিন্তার আমদানি ঘটিয়েছিলেন। টিম মিটিংকে অনেক অর্থবহ করার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিন নিজে কবিতা লিখে সেটা পড়ে শুনিয়েছেন টিমমেটদের। স্টিভ চেয়েছেন, ব্যাগি গ্রিনের মাহাত্ম দিয়ে টিমমেটদের উদ্বুদ্ধ করতে। কিন্তু পেরেছিলেন কি?

যদি সত্যিই পারতেন, তাহলে তাঁর দলে এখন এত বিভাজনের রেখা ফুটে বের হবে কেন! বের হবে। কারণ, ওয়ার্নের মতো অনেকে মনে অশান্তি পুষে রেখেছিলেন। ইয়ান চ্যাপেলের মতো অনেক সাবেক অধিনায়ক আবার কোনো দিনই স্টিভকে অধিনায়ক হিসেবে জাতে তুলতে চাননি! বরং উল্টোটা বলেছেন, ‘পরিণত একটা দল পেয়েছিল, যা নিয়ে মাস্তানি দেখিয়েছে!’ হয়তো অনেকটা তাই। মার্ক টেলরের রেখে যাওয়া ভালো একটা দল পেয়েছিলেন স্টিভ। কিন্তু তা নিয়েও তাঁকে অনেক খাটতে হয়েছে। চিন্তা করতে হয়েছে। হেডেন-ল্যাঙ্গার ওপেনিং জুটিটা তৈরি করেছেন তো সেই স্টিভ ওয়াহ। গ্লেন ম্যাকগ্রাকে অনেক বেশি পরিশীলিত এবং কার্যকর বোলারে পরিণত করার কারিগরের নামও তো স্টিভ ওয়াহ। অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করে দেওয়া, এসবই তো স্টিভের চিন্তার ফসল। সঙ্গে নিজের রানটা তো করেই গেছেন। যে কারণে শচীন-লারা-স্টিভ তিনটা নাম একসঙ্গে প্রায় এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হয়েছে। ওয়ার্ন চাইলেও সেই জায়গায় মাইক হাসিকে ঢেলে দিতে পারবেন না। পারবেন শুধু নিজের একাদশে হাসিকে রাখতে।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট মহলের বড় একটা অংশ মনে করে, ওয়ার্নের এসব হচ্ছে এতদিন মনের মধ্যে পুষে রাখা স্টিভ-বিরোধিতা। তবে এসব নিয়ে স্টিভ ওয়াহ কখনোই শব্দ খরচ করতে রাজি বলে মনে হয়নি। এখনো হচ্ছে না। স্টিভের মতবাদটা হচ্ছে এ রকম, ‘যার যা বলার আছে বলে যাক। আমার যা করার ছিল আমি করেছি।’ স্টিভ যা-ই মনে করুক, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের বড় একটা অংশ মনে করে—ওয়ার্ন এখন যা বলছেন, তার পেছনে তাঁর ব্যক্তিগত কিছু রাগ আছে। পাওয়া না-পাওয়ার সমীকরণ আছে। ওয়ার্নবিরোধী কেউ কেউ বলছেন, ১৯৯৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সিরিজের শেষ টেস্টে ওয়ার্নকে ছেঁটে ফেলেছিলেন স্টিভ। ওয়ার্ন ওই সফরে খুব একটা সফল ছিলেন না। ফিটনেসে ঘাটতি ছিল। মুটিয়ে গিয়েছিলেন অনেক। সেই অপমানটা ওয়ার্ন ভুলতে পারেননি! এত বছর পরও। পুরোনো দিনের প্রসঙ্গ বা কোনো কথা উঠলেই তাই তাঁর সাবেক অধিনায়ককে খোঁচা দিতে ভুল করেন না ওয়ার্ন। সেটা ধারাভাষ্য কিংবা তাঁর কলামে হোক। স্টিভ শুধু অফস্টাম্পের বাইরে লেগ স্পিন ছেড়ে দেওয়ার মতো কাজটা করে যাচ্ছেন ওয়ার্নের কথায়।

তবে স্টিভের সাম্রাজ্যের সৈনিকরা এখন যে অনেক ভাগে বিভক্ত, সেটা ওয়ার্নের এই সেরা একাদশ গড়ার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার। স্টিভ সমালোচনার তীরে বিদ্ধ যন্ত্রণাক্লিষ্ট এক সম্রাট ছাড়া অন্য কিছু নন। তাই তাঁর টিমের কিংবা ওয়ার্নবিরোধী শিবির থেকেও কেউ মুখ খুললেন না! ব্র্যাডম্যান বা ইয়ান চ্যাপেল তাঁর টিমমেটদের কাছ থেকে প্রশ্নাতীত আনুগত্য আদায় করে নিতে পেরেছিলেন, যেটা এখনো ইয়ান উপভোগ করেন। এই জায়গাটায় চ্যাপেল থেকে অনেক পিছিয়ে স্টিভ ওয়াহ। তাই বলে ব্যাটসম্যান হিসেবে মাইক হাসির চেয়েও পিছিয়ে! উত্তরটা শুধু ওয়ার্নেরই জানা।

লেখক : সাংবাদিক