কাপ যুদ্ধ

গ্ল্যামার যোগ করলেন কিতারোভিচ!

Looks like you've blocked notifications!

মেসি-রোনালদো চলে গেছেন নকআউট পর্বে। ছিলেন নেইমার। তিনিও গেলেন কোয়ার্টার ফাইনালে। রাশিয়া বিশ্বকাপে থাকল কী! অনেকে একটু রসিকতা করেই বলতে শুরু করেছিলেন, কেন, পুতিন আছেন! হ্যাঁ, তিনি আছেন। ফাইনাল অবধি থাকবেন। আবার তিনি নেই! কারণ, রুদ্ধশ্বাস নাটক শেষে কোয়ার্টার ফাইনালেই তাঁর দেশের সমর্থকরাও পতাকা গুটিয়ে ফেলেছেন।

মেসি-রোনালদো-নেইমারদের বিদায়ে পর বিশ্বকাপ মঞ্চে আবির্ভাব আরেকজনের। না, হ্যারি কেন, কিলিয়ান এমবাপে, গ্রিজম্যান, অ্যাজার-লুকাকু, রাকিতিচ, লুকামদরিচ—এঁরা কেউ নন। সেমিফাইনালের আগ পর্যন্ত রাশিয়া বিশ্বকাপে আপাতত একটাই নাম। কোলিন্দার গ্রাভার কিতারোভিচ! একটু অচেনা লাগছে। লাগতেই পারে। কারণ, ফুটবল গ্রহে আগে কখনো তাঁকে দেখা যায়নি। এই গ্রহে লম্বা সময় ধরে রাজত্ব করছেন মেসি-রোনালদো-নেইমরারা। হ্যারি কেনের গোল, এমবাপের দৌড়, গ্রিজম্যানের দুর্দান্ত শট মেসি-নেইমারদের বিদায়ের পর আলো কাড়তে শুরু করে। কিন্তু মাঠে না নেমে, ক্রোয়াটদের ড্রেসিংরুমে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটিয়েই শিরোনামে কিতারোভিচ! পঞ্চাশোর্ধ্ব সুন্দরী এই নারী ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট। কিন্তু বিশ্বকাপ আর ফুটবল আবেগ এমন এক জিনিস, যা পদপদবির ধার ধারে না। তাই পদমর্যাদার খোলসে তিনি আটকে থাকতে পারেনি। প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্য, এসব ততক্ষণ ছিল যতক্ষণ তিনি বসেছিলেন রুশ প্রধানমন্ত্রী আর ফিফা প্রেসিডেন্টের পাশে। কিন্তু ক্রোয়েশিয়া যখন টাইব্রেকারে রাশিয়াকে ছিটকে দিয়ে পৌঁছে গেল সেমিফাইনালে, তখন ওই সবকিছু উবে গেলে কিতারোভিচের। এবং এটাই স্বাভাবিক। তিনি ছুটে গেলেন ক্রোয়াটদের ড্রেসিংরুমে। ক্রোয়েশিয়ার জার্সি গায়ে।

লুকা মদ্রিচ, রাকিতিচদের সঙ্গে ভেসে গেলেন আবেগের স্রোতে। টুইটারে সেই দৃশ্য জনতার সামনে চলে আসার পর আমজনতার মন থেকে রোনালদো, নেইমার, মেসিরা যেন চলে গেলেন আরো কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে। ফুটবল গ্রহ থেকে দূরে, অনেক দূরে কোনো এক নির্জন দ্বীপে!  এই ক্রোয়েশিয়া যদি ফাইনালে যায় কিংবা বিশ্বকাপ জেতে, তা হলে কী হতে পারে সেই দেশটায় তার আভাস দিয়ে গেলেন দেশটার সুন্দরী এই প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। ফুটবল আবেগ আসলেই কোনো বাঁধ মানে না। তার আকর্ষণ এমন দুর্নিবার। যে আকর্ষণে ছুটে যান প্রেসিডেন্ট থেকে ফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালা থেকে পাইলট কিংবা বিমানবালা। আবেগের স্রোতে ঝাঁপ দিতে বাদ যান না কেউ।

কিন্তু সেই বিশ্বকাপ থেকে যখন মেসি-রোনালদো-নেইমরাররা বাদ পড়লেন, তখন বাঙালির মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল! তাদের বিশ্বকাপই যেন শেষ! ব্রাজিল নেই, আর্জেন্টিনা নেই; কী আর আছে বিশ্বকাপে! ইউরোপের চারটা দেশ কাপ জয়ের জন্য এখন লড়াই করবে। সেই দেশ চারটার মানুষ আনন্দ-উল্লাস করবেন। হেরে গেলেন আবার উঠে দাঁড়াবেন। এটাই তো এখন রাশিয়ার বিশ্বকাপ!

রং বদলেছে বিশ্বকাপ। ফাইনাল-সেমিফাইনালের টিকেটের হাতবদলও শুরু হয়েছে। ব্রাজিলিয়ান সাম্বার পূজারি আর সাম্বা সুন্দরীরা সেমিফাইনাল, ফাইনালের টিকেট বেঁচে দিয়ে দেশে ফেরার বিমান ধরার চেষ্টা করছেন। ব্রাজিল নেই। তাঁরা থেকে কী করবেন! বিশ্বকাপে সাম্বা নৃত্য শেষ। কিন্তু ক্রোয়াট ড্যান্স শুরু। আর সেটা শুরু করে দিলেন ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট নিজেই। ড্রেসিংরুম থেকে সেই নাচ যদি শুরু হয়ে যায় মাঠে, তাহলে হ্যারি কেনের আলোয় পথ দেখতে পাবে না ইংলিশরা। ‘ফুটবল বাড়ি ফিরবে’ ইংলিশদের সেই স্বপ্নও পূরণ হবে না। আপাতত ইংলিশদের বিশ্বকাপের রিংটোন বাংলাদেশের একটা মোবাইল অপারেটর কোম্পানির বিজ্ঞাপনের সেই চেনা সুর : ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি!’  ঈদ উৎসব এলে সেটা একটু বেশি শোনা যায়। এবারের বিশ্বকাপ নামক ফুটবল উৎসবে ইংলিশদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বারবার কানে বাজছে সেই বিজ্ঞাপনের সুর। স্বপ্ন যাবে বাড়ি!  কোনো এক মা হারিকেন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ছেলে বাড়ি পৌঁছাবে একটা ফোন নিয়ে! ইংলিশরাও অপেক্ষায়, হ্যারি কেন কাপ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।

৫২ বছর আগে ববি মুর ব্রিটিশ রানির হাত থেকে বিশ্বকাপ নিচ্ছেন, সেই ছবির পাশে আরেকটা ছবি ফ্রেমবন্দি করে এফএর ফুটবল মিউজিয়ামে রাখার স্বপ্ন এখন ইংলিশদের। রানি এলিজাবেথও হয়তো দেখে যেতে চাইছেন ইংলিশরা ফুটবলকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে। ফরাসিরাও কাপ ঘিরে আবার দেশে নতুন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন। তাদের প্রতিবেশী বেলজিয়াম অধরা কাপ ধরে দেখার সেরা সুযোগ মনে করছে এবার রাশিয়ায়।

কিন্তু খালি হাতে ফেরা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল-উরুগুয়ে? তারা ফিরে গেছে ঠিকই, কিন্তু হারিয়ে যায়নি। যাবে না। কারণ, ওরা ফুটবল স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। ফুটবল ওদের অক্সিজেন। তাই রাশিয়া থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া মৃত স্বপ্নের কফিনটা নামিয়ে রেখে নতুন ফুটবল খনির সন্ধানে নেমে পড়েছে। লাতিন দেশগুলো তো ফুটবলের খনি। সেখানে কত আনপলিশড ডায়মন্ড পড়ে আছে। ইউরোপ তাদের তুলে এনে ঝকঝকে করে তোলে। এবারের বিশ্বকাপটা যতই শেষ পর্যন্ত ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ হয়ে দাঁড়াক, বিশ্বকাপ কিন্তু আবেগে মোড়ানো তার গ্ল্যামার কিছুটা হলেও হারিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপ মঞ্চে আপাতত গ্ল্যামারের সব আলো কেড়ে নিলেন এক ক্রোয়াট নারী। লুকা মদ্রিচ, রাকিতিচদের সৌজন্যে ফুটবল বিশ্ব নতুন করে যাকে চিনল!

সত্যিই ফুটবল শুধু একটা একটা খেলা নয়। খেলার বাইরেও আরেকটা খেলা থেকে যায়। ফুটবল কত মানুষকে অন্যভাবে চিনিয়ে দিয়ে যায়। ফুটবল জন্ম দিয়ে যায় নতুন ভাষার। নতুন সংস্কৃতির। নতুন ইতিহাসের। সে কারণেই ফুটবল বিশ্বকাপ সত্যিই অপূর্ব সুন্দর।

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।