কাপ যুদ্ধ

বেলজিয়ামের স্বপ্নের দৌড় থামিয়ে দিল ফ্রান্স

Looks like you've blocked notifications!

সেন্ট পিটার্সবার্গে ইতিহাস উঁকি দিল। একজনকে বৃহত্তর ইতিহাসের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ার হাতছানি দিয়ে গেল। আর একজনের নয়া ইতিহাস গড়ার স্বপ্নকে শেষ করে দিয়ে গেল। আসলে সেন্ট পিটার্সবার্গ ইতিহাসের শহর। যুদ্ধের শহর। লড়াইয়ের শহর। কাপ যুদ্ধের সেমি লড়াইটা সেখানে দুর্দান্ত হবে, সে রকম বাতাবরণ আগেই তৈরি হয়েছিল। দুই প্রতিবেশীর লড়াই। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা দুটো দলের লড়াই। সেই লড়াইটাকে আরো দুর্ধর্ষ  করে তোলার জন্য দুই দলের ডাগআউটে ছিল দুর্দান্ত দুটো মগজাস্ত্র।তাদের একজন দিদিয়ের দেশম। ফরাসি কোচ। অন্যজন রবাতো মার্টিনেজ। বেলজিয়ামের কোচ।

মার্টিনেজ বেলিজিয়ানদের নতুন ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। প্রথমবারের মতো দলকে ফাইনালে তোলার স্বপ্ন। তিনি বেলজিয়ানদের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। বেলজিয়ানদের কাছে সেই স্বপ্নটা আরো রঙিন করে দিয়েছিল ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান। ১৯৯০ সাল থেকে যে দল ব্রাজিলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে এসেছে, তারা ফাইনাল খেলেছে। কিন্তু সেই ইতিহাস আর পরিসংখ্যানকে থমকে দিল দেশমের ফ্রান্স। যে বেলজিয়াম কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে স্বপ্ন দেখছিল ফাইনালের, তাদের স্বপ্নের দৌড় থামিয়ে দিল ফ্রান্স। শুধু থামিয়ে দিল না। উল্টো দেশমের সামনে খুলে দিল নতুন দরজা। ফাইনাল জিততে পারলেই বিশ্বকাপ ইতিহাসের অভিজাত সরণির বাসিন্দা হয়ে যাবেন দেশম। যে সরণির বাসিন্দা এখন মাত্র দুজন। ব্রাজিলের মারিও জাগালো আর জার্মানির ফেঞ্চ বেকেনবাওয়ার। ফুটবলার এবং কোচ হিসেবে শুধু তাঁরাই জিতেছেন বিশ্বকাপ। দেশমের সামনে এখন সেই সুযোগ। ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন তিনি। এবার কোচ হিসেবে জিতলে তিনি ইতিহাসের যে সরণির বাসিন্দা-ই হোন না কেন, ফরাসিদের হৃদয়বাসী হয়ে যাবেন তা নিয়ে সামান্যতম সংশয়ের কিছু নেই।

ফুটবল নিয়ে ফরাসিরা উদ্বেল। একই সঙ্গে অনেক বেশি রুচিশীল। ফুটবল এদের কাছে লিবার্টি। মুক্তিসাধনের ঠিকানা। সব ফরাসিই সেই ফুটবলের মাঝে মুক্তিসাধনের অন্য রকম ঠিকানা খুঁজে বেড়ান। ’৯৮ এ দেশম-জিদান-অঁরিরা বিশ্বকাপ জেতার পর ফরাসি ফুটবল পেয়েছে একরকম রূপকথার চেহারা। ২০০৬ সালেও ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছিল। কিন্তু সেবার কাপ জেতা হয়নি তাদের। কিন্তু সেই ব্যর্থতা আর স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা ভুলে ফরাসিরা আস্থা রাখছেন দেশমের এই দলটার ওপর। দেশম ফুটবলার হিসেবে ফরাসিদের কাছে ছিলেন পয়মন্ত। তার হাতেই বিশ্বকাপ উঠেছিল। ফরাসিদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। এবার কোচ হিসেবেও তিনি তাদের স্বপ্ন পূরণের খুব কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। আর মাত্র একটা হার্ডল পেরোলেই কাপ ফ্রান্সের। সেই হার্ডলের নাম ফাইনাল।

কিন্তু ফাইনাল খেলা। ফাইনাল জেতার ইতিহাস ও ঐতিহ্য দুটোই আছে ফরাসিদের। দেশমের কাপ ভাগ্যের কারণে ফরাসিরা এখনই তাঁকে বলতে শুরু করেছেন ‘সৌভাগ্যশালী বিশ্বজয়ী’ কাপ ফ্রান্সে আসছে। সেই স্বপ্ন দেখছেন দেশটার প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাকরোঁ থেকে সাধারণ মানুষ। ফরাসি প্রেসিডেন্ট তো সবকিছু ফেলে রেখে ছুটে গেছেন রাশিয়ায়। সেন্ট পিটার্সবার্গে বাসে তিনিও দেখলেন ফ্রান্সের সেমিফাইনাল জয়। দেখলেন ফরাসি ফুটবলের নান্দনিকতার জয়। আর জয় উদযাপন। সেখানেও নান্দনিকতার ছোঁয়া।

সমুদ্রের ঢেউর মতো  আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ ছিল ম্যাচটায়। প্রথম দিকে বেলজিয়ামের আক্রমণের লাল ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করে ফরাসি দুর্গে। তারপর ফরাসিরা ঝাপায় পাল্টা আক্রমণে। বেলজিয়ানদের দৌড় থামিয়ে দিল একটা কর্নার কিক। গ্রিজম্যানের কিক। আর তাতে স্যামুয়েল উমিতিতির মাথার ছোঁয়া। তারপরই সেন্ট পিটার্সবার্গে গ্যালারি নীল সমুদ্র। যেখানে আছড়ে পড়তে থাকে ফরাসিদের উচ্ছ্বাসের ঢেউ। সেই ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেল লাল-হলুদের বেলজিয়ানদের স্বপ্নকে।

সেন্ট পিটার্সবার্গে ইতিহাস গড়া হলো না বেলজিয়ান লাল ফৌজের। অথচ এই সেই সেন্ট পিটার্সবার্গ। বিশ্বযুদ্ধের সময় যেখানে দীর্ঘদিন হিটলার বাহিনী আটকে রেখেছিল রাশিয়ান লাল ফৌজদের। কিন্তু তারা দমে যায়নি। শেষ পর্যন্ত পরাস্থ করেছিল হিটলার বাহিনীকে। কিন্তু সেই পিটার্সবার্গে বেলজিয়াম লাল ফৌজ হতে পারল না। রবার্তো মার্টিনেজেরও ইতিহাস গড়া হলো না। যিনি বেলিজিয়ামের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে এসেছিলেন। তাঁর সামনে ইতিহাস উঁকি দিয়ে মিলিয়ে গেল!

সেন্ট পিটার্সবার্গে হিটলার বাহিনীর হাতে আটকে পড়ার সময় সেখানকার মানুষের বেঁচে থাকার আনন্দ ছিল বেল ড্যান্স আর ফুটবল। সেমিফাইনালে তার দুটোই তারা দেখে ফেললো বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ফ্রান্স-বেলজিয়াম ম্যাচে। স্কোর লাইন ভুলে গেলে আপনাকে বলতেই হবে দুর্দান্ত এক ম্যাচ। এই ম্যাচের আগে ক্ল্যাসিক শব্দটা বসাতে কার্পণ্য তারাই করবেন। যারা শুধু আবেগে বুঁদ হয়ে সবুজ মাঠে ছবি আঁকা দেখতে চান। ফুটবল ছন্দের মাঝে কবিতার মিল খুঁজে বেড়ান। কিন্তু এই ম্যাচ কত স্বপ্নে দৌড় দেখাল। কত ফুটবলার তাদের জীবন সংগ্রামকে রূপকথা বানিয়ে দিয়ে গেল এই ম্যাচে। পাবেন, একটু খুঁজলে অনেককেই পাবেন। যাদের জীবন দুঃখ-কষ্ট-সংগ্রামের রূপকথা। স্যামুয়েল উমিতিতি, ম্যাচের ভাগ্য গড়লো যার মাথা, তিনি গোল করার পর যে নাচটা দেখালেন, তাঁকে আবেগের উদ্দাম নৃত্য আপনি বলতেই পারেন। কিন্তু সেই উমিতিতি মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন ইতিহাসকে। রজার মিলারের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। গোল করে কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে দৌড়ে গিয়ে তার সেই বিখ্যাত নাচ। তাঁকে মনে রাখতে হবে ফুটবলবিশ্বকে। স্যামুয়েলের জন্ম কিন্তু সেই মিলারের দেশ ক্যামেরুনে। জীবনের গল্পকে অন্যভাবে লিখতেই তার ফ্রান্সে আসা।

সেই স্যামুয়েল কিন্তু সেমিফাইনালে ফরাসিদের জয়ের গল্পে নায়ক হয়ে গেলেন। কিলিয়ান এমবাপের দৌড়, গ্রিজম্যানের কিক, সবকিছু ছাপিয়ে স্যামুয়েলের গোল আর নাচ। সেন্ট পিটার্সবার্গের সেমিফাইনাল আসলে অনেক রঙের কোলাজ।

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।