অভিমত
সংরক্ষিত আসনের দর্শন ও রাজনীতি
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ইস্যুতে চলমান আন্দোলনের মধ্যেই সংসদে পাস হলো সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনীযার মাধ্যমে সংসদে সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনের মেয়াদ আরো ২৫ বছরের জন্য বাড়ানোর হয়েছে। অর্থাৎ আরো ২৫ বছর সরাসরি ৩০০ আসনে নির্বাচনের পরে সংসদে কেবল নারীদের জন্য ৫০টি আসন নির্ধারিত থাকবে—যেখানে ৩০০ আসনে বিজয়ী দলগুলো তাদের আসনের বিপরীতে আনুপাতিক হারে ওই সংরক্ষিত আসন পাবে।
এটিও একধরনের কোটা। বলা হয়, যেহেতু নারীরা এখনো পিছিয়ে আছে, তাই তাদের ক্ষমতায়নের জন্য এই সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা। যদিও এই তর্কটি আমরা করছি যখন সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলছে এবং প্রতিনিয়তই সেই আন্দোলনের ডাইমেনশন পরিবর্তন হচ্ছে। জাতীয় সংসদে খোদ প্রধানমন্ত্রী ‘কোটা থাকবে না’ বলে ঘোষণা দেয়ার পরও এ নিয়ে সহিংসতা থামেনি। কোটা সংস্কার অথবা বাতিল ইস্যুতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি কাজ করছে। শেষমেষ কী সিদ্ধান্ত হয়, তা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমাদের আজকের আলোচনা অন্য কোটা নিয়ে।
আইন প্রণয়নে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সংবিধানে সংরক্ষিত নারী আসন চালু হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ১৯৭২ সালে। সেই থেকে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের পরই সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ থাকছে। বিভিন্ন সময়ে আসনের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
গত ২৯ জানুয়ারি, যেদিন মন্ত্রিসভায় আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়, ওই বৈঠকেই জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত (নারী) আসনের মেয়াদ ২৫ বছর বাড়িয়ে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনীর খসড়ায় অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। যদিও আলোচনার টেবিলে ইস্যু হিসেবে এটি তখন জায়গা পায়নি। সম্ভবত নারী আসনের রাজনৈতিক গুরুত্ব কম বা আলোচনার ইস্যু হিসেবে এটি ওই অর্থে খুব যুৎসই নয়।
সংবিধান অনুযাযী, সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে আগামী বছরের জানুয়ারিতে। তাই আগামী নির্বাচনের আগেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই বাধ্যবাধকতা থেকেই ৮ জুলাই সংসদে পাস হয় ‘সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) আইন ২০১৮। দু’দফা বিভক্তি ভোটে সরকার ও বিরোধী দলের উপস্থিত ২৯৮ জন সংসদ সদস্যের সবাই ’হ্যাঁ’ ভোট দিয়ে বিলটিতে সমর্থন জানান। প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী এই বিভক্তি ভোট চলার পর ভোট গণনা শেষে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ২৯৮:০ ভোটের ব্যবধানে সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাসের ঘোষণা করেন। প্রসঙ্গত, বিলটি পাসের আগে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং স্বতন্ত্র ৯ জন সংসদ সদস্য জনমত যাচাই-বাছাই ও সংশোধনী প্রস্তাব আনলেও তা ভোটে নাকচ হয়ে যায়।
যদিও এই সংরক্ষিত আসনের এমপিদের কাজ ও এখতিয়ার, প্রয়োজনীয়তা, নারী উন্নয়নে সংরক্ষিত আসনগুলো আসলেই কতটা ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে বিভিন্ন সময়েই বিতর্ক হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। বিশেষ করে নবম সংসদে প্রধান দুটি দলের সংরক্ষিত আসনের বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যের আচরণ ও কথাবার্তায় এই পদটি যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। অনেক সময় এমন কথাও উঠেছে যে, সংরক্ষিত আসনগুলো আসলে আলঙ্কারিক।
প্রশ্ন হলো, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন কেন থাকতে হবে? নারীরা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ, তাই তাঁদের জন্য সংসদের সংরক্ষিত আসন থাকা উচিত, এর পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। যেমন সমাজ ও রাষ্ট্রের আরও যেসব পিছিয়ে পড়া অংশ যেমন আদিবাসী (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী), ধর্মীয় সংখ্যালঘু, শারীরিক প্রতিবন্ধী, দলিত- তাদের জন্য সংসদে আসন কেন সংরক্ষিত থাকবে না?
আমাদের দেশের নারীরা যে পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই, তার বড় প্রমাণ রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়ই নারীরা সগর্বে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান সংসদের ২২ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত। যাঁদের মধ্যে গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত শেখ হাসিনা এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জাতীয় সংসদের স্পিকার, ফরিদপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সংসদ উপনেতা, ময়মনসিংহ-৪ আসন থেকে নির্বাচিত রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, শেরপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত বেগম মতিয়া চৌধুরী কৃষিমন্ত্রী, যশোর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত ইসমাত আরা সাদেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। নবম সংসদেও শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, সাজেদা চৌধুরী, রওশন এরশাদ, মতিয়া চৌধুরী, দীপু মনিসহ ১৮ জন নারী সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। সুতরাং নারীদের জন্য আলাদা করে ৫০টি আসন কেন রাখতে হবে?
সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যরা কোনো নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন না। তারপরও তাঁদের সাংবিধানিক মর্যাদা সরাসরি নির্বাচিত এমপিদের মতোই। প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিতদের মতোই তাঁরা প্রিভিলেজ বা বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন। বিল পাস ও সংসদের অন্যান্য প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। এমনকি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও হতে পারেন। তাঁদের বেতন-ভাতা-সম্মানী এবং শুল্কমুক্ত গাড়ি আনার সুযোগও সরাসরি নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামাজিকভাবে সংরক্ষিত আসনের এমপিদের খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কারণ তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো নির্বাচনী এলাকা নেই। কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হলেও সেই এলাকায় যেহেতু সরাসরি নির্বাচিত এমপি রয়েছেন, ফলে ভোটার ও অন্যান্য মানুষের কাছে সংরক্ষিত আসনের এমপিরা ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হন। বড় কোনো সমস্যার সমাধান বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসনের এমপিদের বিবেচনা করা হয় না।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, প্রতিপক্ষকে অসংসদীয় ভাষায় আক্রমণে এই সংরক্ষিত নারী আসনের এমপিরাই এগিয়ে থাকেন। এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাটা কী? রাজনৈতিকভাবে তাঁদের ক্ষমতা ও এখতিয়ার কম বলে সেটি সংসদে হইচইয়ের মাধ্যমে পুষিয়ে দেন? নবম সংসদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন সংরক্ষিত আসনের এমপি সংসদে তাঁদের ‘গলাবাজি’র কারণে মোটামুটি মার্কামারা হয়ে গিয়েছিলেন। যদিও গত কয়েক বছরে এই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। কারণ সংসদে বিএনপি নেই। বিরোধী দল নামে জাতীয় পার্টি থাকলেও তারা যেহেতু সরকারেরও অংশ, ফলে তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে ‘সরকারি বিরোধী দল’ হিসেবে। এ কারণে কয়েক বছর ধরে সংসদে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার একেবারেই কমে গেছে।
প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত এই ৫০ জন নারী সাংবিধানিকভাবে আইনপ্রণেতা, কিন্তু তারপরও শাসনকাজে তাঁদের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। একজন নারী সদস্যকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, গত ৫ বছরে আপনি কী কী করেছেন, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কী ভূমিকা রেখেছেন, তাতে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো জবাব আসবে বলে মনে হয় না।
নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা—এমন কথা বলা হলেও বাস্তবতা হলো এর দ্বারা লাভবান হয় মূলত দল। অর্থাৎ ৩০০ আসনে জয়ের আনুপাতিক হারে দলগুলো যেহেতু সংরক্ষিত আসন পায়, ফলে জাতীয় নির্বাচনে যে দল সবচেয়ে বেশি আসন পায়, তারাই আবার আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি সংরক্ষিত আসনের মালিক হয়। এটা অনেকটা ক্ষমতাবানকে আরও ক্ষমতায়িত করার একটা কায়দা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটে অর্থাৎ পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হওয়া ওই ৫০ জন নারীকে মনোনয়ন দেয় দল। মূল ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিকারীদের মতো তাদের নির্বাচনি হলফনামা দিতে হয় না। ফলে তাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ খুব বেশি কিছু জানার সুযোগ পায় না। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক তারকাও থাকেন। ফলে তাদের সম্পর্কে মানুষ অল্পবিস্তর জানে। তাও মুদ্রার একপিঠ। আবার এই সংরক্ষিত আসনে কারা মনোনয়ন পাবেন, কী তাদের যোগ্যতা—সে বিষয়ে দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সব মিলিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সংরক্ষিত আসনের কথা বলা হলেও আদতে এর দ্বারা নারীর ক্ষমতায়ন কতুটুক নিশ্চিত হয়েছে বা হচ্ছে সেই তর্কের অবসান হয়নি।
তাহলে সমাধান কী? সংরক্ষিত নারী আসনের বিধান বাতিল? নিশ্চয়ই না। আমাদের এর বিকল্প বের করতে হবে। নারীরা পিছিয়ে আছেন, সুতরাং তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার পথের বাধাগুলো দূর করতে হবে। কিন্তু সেটি হতে হবে গণতান্ত্রিক উপায়ে। তাঁরা কেন সরাসরি নির্বাচিত এমপিদের ভোটে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হবেন? তাঁরা কেন অন্যের করুণার ওপর নির্ভর করে সংসদের আসন লাভ করবেন? তাঁরা যে পুরুষ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা করেই জয়ী হতে পারেন, তার ভূরি ভূরি উদাহরণ তো আমাদের সামনে রয়েছে। সুতরাং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও কেন নারীদের পরমুখাপেক্ষী করে রাখতে হবে?
সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা বাতিল করে এর বিকল্প হিসেবে সংসদের মূল আসনসংখ্যা ৩০০-এর সঙ্গে সংরক্ষিত ৫০টিকে বিভিন্ন জেলায় ভাগ করে সব দল যদি কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী দিতে বাধ্য হয়, তখন দেখা যাবে সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে এবং সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসার ফলে তাদের মর্যাদা ও গুরুত্বও বাড়বে। কোন কোন আসনগুলো নারীদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে, সেটি দলের নীতি নির্ধারকেরা সিদ্ধান্ত নেবেন। কিছু আসনে হয়তো জটিলতার সৃষ্টি হবে, বিশেষ করে যেখানে দলের পুরুষ প্রার্থী অনেক বেশি ক্ষমতাবান, সেখানে তুলনামূলক কম ক্ষমতাবান নারীকে প্রার্থী করলে দলীয় কোন্দল বেড়ে যাওয়া কিংবা ওই নারী প্রার্থীর হেরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কিন্তু এটি নারীদের ব্যাপারে আমাদের সামগ্রিক রাজনীতির যে বিবেচনা ও দৃষ্টিভঙ্গি, সেটিও পরিবর্তন করা দরকার। নারী মানেই তাঁর জন্য বিশেষ সুবিধা রাখতে হবে, এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসারও সময় হয়েছে। তা ছাড়া শিক্ষিত নারী কারো করুণা চায় বলেও মনে হয় না।
নারী জনপ্রতিনিধিদের স্রেফ অলঙ্কার বলে বিবেচনা করা হবে না। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, সাজেদা চৌধুরী কিংবা মতিয়া চৌধুরীর মতো নারীরা যেখানে সরাসরি ভোটে পুরুষকে হারিয়ে বিজয়ী হতে পারেন, সেখানে পরোক্ষ ভোটে ৫০ জন নারীকে নির্বাচিত করার বিধানটি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলে মানা যায় না। সুতরাং নারী উন্নয়নই যদি হয় সংরক্ষিত নারী আসনের মূল দর্শন, তাহলে এই বিধান বাতিল করে তাঁদের কোনো একটি সংসদীয় এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত করে আনা হতেই পারে সেই দর্শন বাস্তবায়নের প্রধান হাতিয়ার।
লেখক : সাংবাদিক