কাপ যুদ্ধ

শরণার্থীদের হাত ধরে ফ্রান্সের বিশ্ব জয়

Looks like you've blocked notifications!

শেষ হলো বিশ্বকাপ নামের এক মহাযুদ্ধ। যে যুদ্ধ মনে করিয়ে দিলো ইতিহাসকে। শেষ পর্যন্ত  সেই যুদ্ধে জয় হলো ঐতিহ্যের। বিশ্ববাসী আরেকবার দেখলো ফরাসি বিপ্লব। এ বিপ্লব ফুটবলের। এ বিপ্লব  ফরাসিদের সেই বাস্তববাদী দর্শনের। বিশ্বকাপ ফ্রান্স আগেও জিতেছে। ফাইনাল তারা আগেও খেলেছে বার দুয়েক। কিন্তু এবারের ফাইনালের আগে তৈরি হয়েছিল অন্যরকম এক আবহ। যেখানে প্রতিপক্ষকে ঘিরে পৃথিবী জুড়ে বইতে শুরু করে আবেগের জোয়াড়! সেই আবেগের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জয়ী হলো ফ্রান্স। ফরাসিদের এই সাফল্যের পেছনে ছিলো তাদের বাস্তববাদী ফুটবল দর্শন।

অনেক লড়াই, অনেক পরিশ্রম, আর হার না মানা মনোভাবের জোরে ফাইনালে উঠে এসেছিল ক্রোয়েশিয়া। তাঁদের অদ্যম লড়াই, পিছিয়ে পড়ার পরও বারবার ফিরে আসার নজির দেখে বাকি  পৃথিবীর মানুষ তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে। তাঁরা স্বাগত জানাতে চেয়েছিল নতুন এক চ্যাম্পিয়নকে। অন্যরা যখন ক্রোয়েটদের নিয়ে আবেগের জোয়ারে ভাসছে, নতুন চ্যাম্পিয়নের স্বপ্ন দেখছে, ফুটবল ঈশ্বর তখন মুচকি মুচকি হাসছেন! কারণ, ফাইনালের চিত্রনাট্যটা তিনি অন্যভাবেই লিখে রেখেছিলেন। তাই ফরাসিরা গোল করার আগেই তারা এগিয়ে গেলো ক্রোয়াটদের আত্মঘাতী গোলে! বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে প্রথম আত্মঘাতী গোল। পিছিয়ে পড়ার পর আবারও ফিরতে শুরু করেছিল ক্রোয়াটরা। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। একে একে আরো তিন গোল করলেন গ্রিজম্যান, পল পগবা, এমবাপে। আর ক্রোয়েটাদের সেই আত্মঘাতী গোলের খানিকটা প্রতিদান দিলেন ফ্রান্সের গোলরক্ষক, অধিনায়ক হুরো লরিচ, একেবারে দৃষ্টিকটু এক গোল হজম করে! সব মিলিয়ে ফাইনালে ছয় গোল!

মস্কোর ফাইনাল যেন ফিরিয়ে দিলো ৫২ বছর আগে ওয়ম্বেলির সেই ফাইনালকে! সেখানেও ছয়টি গোল হয়েছিল। ৫২ বছর আগের ফাইনাল ফিরে এলো ২০১৮ সালে। আবার ঠিক ফিরে এলো তাও বলা যাবে না! কারণ, সেদিন বিশ্বকাপ পেয়েছিল নতুন চ্যাম্পিয়নকে। এবার পেলো না। তবে কাপ ছুঁয়ে দেখা না হলেও ক্রোয়াটরা ছুঁয়ে গেছে বিশ্ববাসীর মন। তাদের আবেগে ভেসেছেন অনেকে। সেই আবেগের ঢেউ পৃথিবীর বহুপ্রান্তে আছড়ে পড়েছে। বাদ যায়নি এই বাংলাদেশও। নতুন চ্যাম্পিয়নকে স্বাগত জানাতে, ক্রোয়াটদের আবেগে উদ্বেলিত হয়েছিল এত মানুষ, যা দেখে মনে হয়েছে এটাই বোধহয় গণসমর্থন। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই এবারের বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে মন আর মস্তিস্ক সত্যিই দুই প্রান্তের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল অনেকের। তাদের মন বলেছে ক্রোয়েশিয়া জিতুক। কিন্তু মস্তিস্ক বলেছে ফ্রান্স। শেষ পর্যন্ত জয় হলো মস্তিকের। জয় হলো ইহিাসের। জয় হলো ঐতিহ্যের।

চ্যাম্পিয়ন হতে হলে ফাইনাল খেলার অভ্যাস লাগে। কাপ তারাই জেতে যাদের কাপ জেতার অভ্যাস আছে। সেটা মস্কোতে ফুটবল বিশ্ব আরও একবার দেখল। আর ফরাসিদের এই কাপ জয়ের পেছনে তাদের একটা দর্শন শাস্ত্রের ব্যাখ্যা ছিল। ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেঁশম, নিজে অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন। কোচ হিসেবেও জিতলেন। ব্রাজিলের মারিও জাগালো, জার্মানির ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ারদের অভিজাত সরণির বাসিন্দা হয়ে গেলেন দেঁশম। বিশ্বকাপ জয়ী ফান্সের সাবেক অধিনায়ক তার ফুটবলারদের বারবার একটা কথাই বলে তাতিয়েছেন: ‘ বিশ্ব শুধু চ্যাম্পিয়নদেরকেই মনে রাখে। পরাজিত দলকে কেউ মনে রাখে না। তোমরা এই ম্যাচটা হারলে শুধু একটা ম্যাচ হারবে না। সোনার কাপটাকে মাঠে রেখে যাবে। আমরা এখানে এসেছি কাপ নিয়ে যেতে।’ গ্রিজম্যান, পল পগবা, এমবাপেদের আর কি লাগে উজ্জীবিত হতে! সত্যিই দলীয় সংহতির বারুদেই ফাইনালে তারা জ্বলে উঠল। আর তাতেই শেষ ক্রোয়াটদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।

তবে হ্যাঁ, ক্রোয়াটরা কাপ ছাড়াই দেশে ফিরল। নিয়ে গেলো বাকি পৃথিবীর ভালোবাসা। আর বিশ্বকে নতুন এক বার্তা দিয়ে গেলো। তারা উঠে আসছে। নতুন ফুটবল শক্তি হিসেবেই উঠে আসছে। মস্কোতে পারলো না। কিন্তু কাতারে পারবে না তাই বা বলছি কিভাবে! ক্রোয়াটরা লড়াকু। যুদ্ধজয়ী এক জাতি। ওরা ঘুরে দাঁড়াতে জানে। হয়তো আগামীতে আরো শক্তিশালী হয়েই বিশ্বকাপে ফিরে আসবে।

কাপ প্যারিসে ফিরলো। গত বিশ বছরে তিনটা বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলল ফ্রান্স। জিতেছে দু’বার। এবারের ফাইনালটা তারা যেভাবে জিতলো এবং যাদের নিয়ে জিতলো তার মাঝেও নতুন এক বার্তা পাওয়া গেলো। যুদ্ধদীর্ণ বহু জীবনকে সম্মান জানিয়ে গেলো ফ্রান্স। ফরাসি বিপ্লব, যুদ্ধ, দাঙ্গা, সন্ত্রাসী হামলা কত কিছুই দেখেছেন ফরাসিরা। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে গড়ে উঠেছিল নতুন এক ফ্রান্স। সেই নতুন ফ্রান্সেরই জয় হলো। বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স নিজেদের উপনিবেশ থেকে আরব-আফ্রিকানদের নিজের দেশে আনতে শুরু করলো। কাজের জন্য। যুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য তাদের দরকার ছিল কাজের লোকের। সে কারণেই সেখানে অ-ফরাসিদের আনা হলো। কিন্তু তাতে আবার মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখেছিল ফরাসিরা: দাঙ্গা, মাদক, সন্ত্রাস। যাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল শহরের বাইরে বিভিন্ন শহরতলীর বস্তিতে। সেই অশ্বেতাঙ্গ মানুষগুলোকে ওরা  জড়িয়ে দিলো ফুটবলে। এদের কেউ ছিলেন আলজেরিয়ান, কেউ ঘানার, কেউ কঙ্গোর। কিন্তু সে সময় অর্থাৎ ১৯৬০ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স কোন ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্ট জিততে পারেনি। খেলতে পারেনি বিশ্বকাপ। কিন্তু তারা নীরব বিপ্লবের স্বপ্ন তৈরি করছিল। সেই বিপ্লব ফুটবলের। ইউরোপে সবার আগে অত্যাধুনিক ফুটবল একাডেমি গড়ে তোলে ফ্রান্স। যেটা তাদের স্বপ্নের কারখানা। আর সেখান থেকেই বেরিয়ে আসতে থাকে অভিবাসী ফরাসি ফুটবল তারকারা। প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স দলে বারোজনই ছিলেন প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী ফরাসি। আর এবার সেই চেহারাটা আরো বেশি ফুটে উঠলো পগবা, এমবাপে, উমিতিতিদের পারফরম্যান্সে। এদের হাত ধরে আবার কাপ জিতলো ফ্রান্স।

ফ্রান্সে ছাত্র বিপ্লবের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ফরাসিরা আবার দেখলো তাদের ফুটবল বিপ্লবের নতুন রুপ। রাশিয়া থেকে কাপটা নিয়ে ফরাসিরা দেশে ফিরলো। আর ক্রোয়াটরা জানান দিয়ে গেলো, তারা আগামী দিনের ফুটবল শক্তি।

তারকা পতনের বিশ্বকাপে অনেক নতুন ফুটবলার জানান দিয়ে গেলেন, তাদের স্বপ্নের দৌঁড় শুরু। এমবাপের দৌঁড়ের কথা আপনি ভুলবেন কিভাবে! রাশিয়া বিশ্বকাপকেই বা আপনি ভুলবেন কিভাবে। যেখানে কাপ যুদ্ধ শেষেও আপনার মনে হবে না— এটা যুদ্ধদীর্ণ কোন কোটি মানুষের মঞ্চ। মনে হবে এটা গোটা পৃথিবীর মানুষের মহামিলনের এক মঞ্চ। যার নাম বিশ্বকাপ। সেখানে ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া ৫ হাজার ৪শ সেকেন্ডের মহারণ শেষে যা হলো সেটাই আসলে বিশ্বকাপ। যেটা কিছু সময়ের জন্য কারও মন খারাপ করে। কারো মন ভাল করে দেয়। আবার তারা সব ভুলে নতুন স্বপ্ন দেখে আগামী বিশ্বকাপের।

ইংল্যান্ড ফুটবলকে বাড়ি ফেরাতে পারলো না। ক্রোয়াটরা নতুন ইতিহাস লিখতে পারলো না। কিন্তু রাশিয়ায় কাপ রেখে আগেভাগে বাড়ি ফেরা জার্মানদের থিম সঙের কথাগুলোই সত্যি হলো। কাপ যে জেতে জিতুক। কেউ যেন না হারে। আসলে তো তাই! কেউ হারেনি। সবাই মিলে ইতিহাস লিখলো রাশিয়ায়! সেই ইতিহাসের একেকটা অধ্যায়ের নামকরণ আপনি আপনার পছন্দ মত করতেই পারেন। তারকা পতনের বিশ্বকাপ! নতুন তারকার উত্থানের বিশ্বকাপ! ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির বিশ্বকাপ! যা বলার বলতে পারেন। ফিফা কাপটা ফরাসিদের হাতে তুলে দিলো। কিন্তু রাশিয়ায় ফ্রান্স জেতেনি। জিতেছে ফুটবল!

লেখক: সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।