অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য

অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক বাড়াবেন না

Looks like you've blocked notifications!

দেশের শিক্ষার পরিবেশ কোনো না কোনো ইস্যুতে বারবারই বিঘ্নিত হচ্ছে। অথচ এ ক্ষেত্রটিই হওয়া উচিত ছিল সবচেয়ে নির্ঝঞ্জাট ও ঝামেলামুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নানা মত ও পথের শিক্ষকদের আদর্শগত ও স্বার্থগত দ্বন্দ্ব, ছাত্রসংগঠনের আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্রিক সহিংসতা, কখনো শিক্ষকদের রাজনীতি, বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ কত ইস্যুই থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে। রয়েছে উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক ক্ষেত্রেরও নানা দাবি আদায়ের ইস্যু। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় এসেছে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের বেতন-ভাতা ইস্যু। এ স্কেলে সরকারের আমলারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে কেবল বহুগুণেই বেতনভাতার সুবিধাই নির্ধারণ করেননি, সম্মান আর মর্যাদার দিক থেকেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কয়েকধাপ নিচে নামিয়ে দিয়েছেন।

বর্তমান সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রায়ই নানা কথা বলে বিভিন্ন মহলে বিতর্কের জন্ম দেন, এটি নতুন কোনো বিষয় নয়, তাঁর এসব কথাকে আমরা অতটা আমলে নিতে চাই না। তাঁর বয়স বেড়েছে। সম্প্রতি তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে যে অনভিপ্রেত মন্তব্য করেছেন তা শুধু দুঃখজনকই নই, লজ্জারও। একজন মন্ত্রী কীভাবে আর্থ-সামাজিক অনুষঙ্গকে অস্বীকার করেন? প্রচলিত সমাজব্যবস্থা কি তাঁর চিন্তা রেখাকে ছুঁতে পারে না? তিনি যেন বিচ্ছিন্ন এবং এক হীরক রাজার দেশের মন্ত্রী,  যা ইচ্ছা তাই বলেন। তাঁর বিভিন্ন ধরনের কথায় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া শ্রমিক, এঁরা সবাই আক্রান্ত হন।

আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বর্তমান বেতন স্কেলের সুপারিশ নিয়ে বেশ অসন্তুষ্ট। ফরাস উদ্দিন বেতন কমিশনের রিপোর্ট এবং সচিব কমিটির সুপারিশের সঙ্গে শুরু থেকেই দ্বিমত পোষণ করে আসছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে শিক্ষকদের গলায় মূলা ঝুলানো হয়েছে। এ কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড বাদ দিলে শিক্ষকদের বেতন সপ্তম বেতন কাঠামোর তুলনায় দুই ধাপ নিচে পদায়ন করা হয়েছে। অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে গ্রেড-১ আর আগে বসানো হয়েছে আরো দুইটা গ্রেড। মুখ্য সচিব/মন্ত্রিপরিষদ সচিব আর সিনিয়র সচিব। এদের বেতন ধরা হয়েছে যথাক্রে ৯০ হাজার ও ৮৪ হাজার টাকা। এরপর রয়েছে গ্রেড-১। এতে আবার রয়েছে দুটি ক্যাটেগরি; পদায়িত সচিব এবং অপদায়িত বা ওএসডি সচিব। এদের বেতন যথাক্রমে ৭৮ হাজার ও ৭৫ হাজার টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ক্ষেত্রে সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়া হয়েছে। আর পদমর্যাদা নির্ধারণ করা হয়েছে ওএসডি সচিবদের। এ হিসেবে অধ্যাপকরা বেতন পাবেন ৭৫ হাজার টাকা। এ হিসেবেই পদায়ন করে অন্য অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষকদের বেতনধাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। সপ্তম বেতন কাঠামোতে সিনিয়র সচিবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের মতোই বেতন পেতেন। এ কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড বাদ রাখার কথাও বলা হয়েছে।

অথচ উন্নত বিশ্বে শিক্ষকদের মূল্যায়ন করা হয় সবচেয়ে বেশি। উপমহাদেশের আরেক দেশ শ্রীলংকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো রয়েছে। এ কাঠামোতে প্রভাষক থেকে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক পর্যন্ত আমাদের মতোই পাঁচটি ধাপ রয়েছে। এ কাঠামোতে সর্বনিম্ন বেতন ৩৯ হাজার থেকে ৪৮ হাজার রুপি। আর জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকের মূল বেতন মাসিক ৬৭ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৮৭ হাজার পর্যন্ত। এর বাইরেও শিক্ষকদের গবেষণা ভাতা, শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার সুবিধাসহ মাসিক অন্যান্য ভাতাও রয়েছে। পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে দুই লাখ রুপি বেতন রয়েছে। আর সর্বোচ্চ পদের জন্য সর্বনিম্ন প্রায় আড়াই লাখ থেকে সর্বোচ্চ চার লাখ রুপি বেতন বরাদ্দ রয়েছে।

ভারতে রয়েছে পাকিস্তানের মতো অনুরূপ কাঠামো। এ দেশটিতেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা প্রায় সর্বোচ্চ বেতন পেয়ে থাকেন। তাঁদের জন্য রয়েছে সর্বনিম্ন দুই লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ রুপি পর্যন্ত গবেষণা পদোন্নতি বাবদ এককালীন অনুদান। অন্যান্য সুবিধা তো রয়েছেই।

অথচ কেবল আমাদের দেশেই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে ধুম্রজাল ও জটিলতা তৈরি করা হয়েছে। আমলারা আমলাতন্ত্রকে ঠেলে শিক্ষকদের প্রতিযোগী করে তুলছেন। বেতন কাঠামো নিয়ে শিক্ষকরা গঠনমুলকভাবে, তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে, বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সমসাময়িক ও বৈশ্বিক উদাহরণসহকারে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরতে চেয়েছেন। গত কয়েক মাস থেকেই অসন্তোষের এ প্রকাশ ধারাবাহিকভাবেই ঘটছে। এর চূড়ান্ত পর্যায়েই কেবল কর্মবিরতির মতো ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছেন শিক্ষকরা। বিপত্তি ঘটে তখনই, যখন আমলারা মুখস্থনির্ভর যুক্তি দ্বারা শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করতে চান। টিভি টকশো, পত্রিকায় মন্তব্য প্রদানসহ নানা মাধ্যমে শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে তাচ্ছিল্য করেন।

বিষয়টি কেবল শিক্ষকদের জন্য অসম্মানেরই নয়, বরং মর্যাদাগত দিক থেকেও অবমাননাকর। শিক্ষকরাই জাতিগঠন করেন। আগামীর নেতৃত্ব তৈরি করেন। আমলাসহ তাঁদের সন্তানরাও শিক্ষকদের কাছেই জ্ঞানের দীক্ষাগ্রহণ করেন। অথচ সেই আমলারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পান্ডিত্য নিয়ে অনর্থক যুক্তিতে মেতে উঠেন।

একটি দেশের মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তুলেন শিক্ষকরাই। শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠু ও নির্বিঘœ করার পদক্ষেপই সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনই বাড়ানো নয়, উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, প্রাথমিক ও প্রাকপ্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাক্রমের এ ধারাবাহিকতায় কোনো একটি পর্যায়ের অবহেলা মানেই ভিত্তির একটি অংশ দুর্বল করে ফেলা। নানা প্রসঙ্গেই মেধাবী ও শিক্ষিত জাতি গঠনের গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রের প্রধান চালিকাশক্তি শিক্ষকরাই যদি মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়, তবে মেধাবী জাতি গড়ে উঠবে কেমন করে?

অষ্টম বেতন কাঠামোর আরো একটি বিষয় গভীর উৎকণ্ঠার ও উদ্বেগের। এ বেতন কাঠামোর সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর সোজাসাপ্টা অর্থ হলো, শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফরম, ভর্তি ফি, মাসিক বেতন, পরীক্ষা ফি, প্রশাসনিক চার্জসহ যাবতীয় খরচ বৃদ্ধি। বিষয়টি আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে কেবল আত্মঘাতীই নয়, চরম বোকামি। দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী এখনো দারিদ্রের সঙ্গে লড়ছে। তাদের মেধাবী সন্তানদের পড়ালেখার পথই বন্ধ হয়ে যাবে এ রকম অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ফলে। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টিকে অবহেলার খাতায় ফেলে রাখলে চলবে না- এ বিষয়ে সরকারকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।