স্মরণ

অনাদৃত সাংবাদিক-সাহিত্যিক আহমেদ হুমায়ূন

Looks like you've blocked notifications!

একজন বিস্মৃত সাংবাদিক-সাহিত্যিক আহমেদ হুমায়ূন। অনেক বিশিষ্ট সাংবাদিকের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। তাঁদের জীবন ও কর্মের নানা দিক নিয়ে প্রকাশিত হয় স্মারকগ্রন্থ। কিন্তু আহমেদ হুমায়ূনকে আমরা যাঁরা সহকর্মী ছিলাম, তাঁরাও সম্ভবত মনে রাখিনি। তাঁকে নিয়ে কখনো স্মরণসভা হয়নি। স্মারকগ্রন্থ প্রকাশেরও কেউ উদ্যোগ নেননি। অথচ আহমেদ হুমায়ূন একদিকে যেমন প্রতিভাবান সাংবাদিক ছিলেন, অন্যদিকে সাহিত্যের ক্ষেত্রেও রেখে গেছেন সফলতার স্বাক্ষর।

ঢাকা কলেজের কৃতী  ছাত্র আহমেদ হুমায়ূন ছাত্রজীবনে ও পেশাগত জীবনের শুরুতে প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি ঢাকা কলেজে অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত জিএস ছিলেন। পেশাগত জীবনে প্রবেশ করে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন। একপর্যায়ে মতাদর্শগত কারণে কমিউনিস্ট পার্টি রুশপন্থী ও চীনপন্থী হিসেবে বিভক্ত হয়ে যায়। তিনি কিছুদিন চীনপন্থী অংশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পুরোপুরি পেশাগত জীবনে আত্মনিয়োগ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র আহমেদ হুমায়ূন (পুরোনাম সৈয়দ মহিউদ্দিন আহমেদ) পেশার শুরুতে জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। তখন তাঁর সহকর্মী ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক রাহাত খান এবং আরেক স্বনামধন্য সাহিত্যিক শওকত আলী। একপর্যায়ে তিনি একজন রাজনৈতিক সহকর্মী ও সাংবাদিক বন্ধুর অনুরোধে সাংবাদিকতা পেশায় আসেন। সাংবাদিকতায় সূচনায় তিনি দৈনিক ইত্তেফাক গ্রুপের ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা টাইমস’ পত্রিকায় (সম্পাদক ছিলেন এ দেশের সাংবাদিকতার কিংবদন্তি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া) যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে সহকারী সম্পাদক সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তানে (স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলা, যা বর্তমানে বিলুপ্ত)। আহমেদ হুমায়ুন দৈনিক বাংলায় নিয়মিতভাবে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতেন। নগর দর্পণ নামে প্রতি শুক্রবার তাঁর একটি কলাম ছাপা হতো।

সুপান্থ ছদ্মনামে তিনি ১৯৭০ সাল থেকে নগর দর্পণ লিখতে শুরু করেন। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত টানা প্রায় একুশ বছর তিনি ‘নগর দর্পণ’ লিখেছেন। এত দীর্ঘ সময় এই কলামটি লেখা প্রসঙ্গে আহমেদ হুমায়ূনের ব্যাখ্যা : ‘নগর দর্পণ কেন লিখি? জীবিকার জন্য লিখি। যেহেতু কর্মজীবী সাংবাদিক, কিছু না কিছু আমাকে লিখতেই হয়। নগর দর্পণ আমার সেই লেখালেখিরই অংশ। এর বেশ কিছু কি নেই?  আছে, কলামটি আমি নিজে পছন্দ করে নিয়েছি এবং দীর্ঘদিন ধরে লিখছি। যখন এই নগরী এত বড় ছিল না, যখন ঢাকার জীবন এমন জটিল হয়ে ওঠেনি, যখন নগরীতে ফুলের দোকান ছিল না, ফুটপাতে শুধু ভাতের দোকান ছিলো। তখন থেকেই লিখছি।’ ঢাকা নগরীর উত্থান, নাগরিক জীবনের দুঃখ-বেদনা, পাওয়ার আনন্দ, না পাওয়ার হতাশা, এককথায় নগরের কালের ইতিহাসকে ধারণ করে আছে এই কলাম। স্বাদু গদ্যে লেখা নগর দর্পণ ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা অর্জন করে। নগর দর্পণে তিনি নিয়মিত লিখতেন ‘ঢাকাই লিমারিক’। তাঁর মৃত্যুর অনেক পর নগর দর্পণ বই হিসেবে প্রকাশিত হয়।

সহকারী সম্পাদক পরে দৈনিক বাংলার নির্বাহী সম্পাদক এবং সম্পাদক হিসেবে অসাধারণ পেশাদারিত্বের ছাপ রেখে গেছেন আহমেদ হুমায়ূন। এ প্রসঙ্গে দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর সংঘটিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির কথা স্মরণে আসে। আহমেদ হুমায়ুন তখন সম্পাদক। এই ঘটনা জেনে সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্তদের, যেমন : সিটি এডিটর, চিফ রিপোর্টার এবং উপস্থিত সব রিপোর্টারকে ডেকে নেন। সংক্ষিপ্ত মিটিং করে তিনি পুরো রিপোটিং টিমকে এই ট্র্যাজেডি কাভার করার নির্দেশনা দেন। সর্বোচ্চ কাভারেজ যাতে হয়, সে জন্য প্রথম পাতার মেকআপ পরিকল্পনা করতে পরামর্শ দেন বার্তা সম্পাদককে। আমি তখন দৈনিক বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার থেকে স্টাফ রিপোর্টার পদে নিয়োগ পেয়েছি মাত্র। আমাকে ডেকে বললেন যে তিনি নিজে ঘটনাস্থলে যেতে চান। সম্পাদকের গাড়িতে আরো দুজন সিনিয়র রিপোর্টারের সঙ্গে আমাকে নিয়ে আহমেদ হুমায়ূন ছুটলেন। টিএসসি এলাকায় সংগত কারণে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্যান্য যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল। গাড়ি ছেড়ে হেঁটেই আমরা ঘটনাস্থলের কাছে যাই। সেখানে এককথায় অবর্ণনীয় দৃশ্য দেখার পর সম্পাদক নিহত-আহতদের অবস্থা দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও যান। অফিসে ফিরে বিভিন্ন রিপোর্টের শিরোনাম নিজ হাতে করে পত্রিকার মেকআপও তত্ত্বাবধান করেন। পরের দিনের পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ অন্য দু-একটি ঘটনা ছাড়া প্রথম পাতার পুরোটা জুড়েই ছিল জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির খবর।

১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে দৈনিক বাংলায় সিরিজ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। আহমেদ হুমায়ূন কয়েকটি সাক্ষাৎকার গ্রহণে রিপোর্টারের সঙ্গে নিজে উপস্থিত থেকে অংশ নেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সেইসব সাক্ষাৎকার সম্পাদক ও রিপোর্টারের যৌথ নামে ছাপা হয়। আহমেদ হুমায়ূন প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ  দেন। অধিবেশনের খবর কাভার করেছেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় (বর্তমানে বিলুপ্ত) আন্তর্জাতিক বিষয়ে নিয়মিত দীর্ঘদিন কলাম লিখেছেন। এই কলাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং বিসিএস পরীক্ষার্থীদের মাঝে জনপ্রিয়তা পায়।

সাহিত্যিক হিসেবে আহমেদ হুমায়ূন সমান দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে লেখা ‘বিপরীত স্রোতে রবীন্দ্রনাথ’। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে বড় চরিত্র কৃষক, অথচ এই কৃষক সব দেশে সব কালে উপেক্ষিত থেকেছে। কৃষকদের নিয়ে তাঁর বই ‘আলেফ মিয়ার ডায়রি’। প্রধান চরিত্র আলেফ মিয়া একজন কৃষক। স্যাটায়ার ঢংয়ে লেখা এই বইয়ে আহমেদ হুমায়ূন দরদ দিয়ে বাংলার কৃষকের দুঃখ ও বঞ্চনার কাহিনী তুলে ধরেছেন।

আহমেদ হুমায়ূন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। ফিচার লেখা নিয়ে তাঁর ‘ডাবল কলাম, সিঙ্গেল কলাম’ নামে একটি বই আছে। তাঁর লেখা মোট পাঁচটি বইয়ের মধ্যে আরেকটি বই হচ্ছে ‘ঢাকাই লিমারিক’। এ ছাড়া তাঁর লেখা কিছু ছোট গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিকদের রুটি-রুজির প্রশ্নেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে গেছেন। অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। এরশাদের সামরিক শাসনের সময় দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক নির্মল সেনকে (যিনি একটি বাম রাজনৈতিক দলের সভাপতি ছিলেন) চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য সম্পাদক আহমেদ হুমায়ূনকে চাপ দেওয়া হয়। নির্মল সেন তখন কারাগারে। আহমেদ হুমায়ূন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন যে, একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসাবে তাঁর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। আর যদি নির্মল সেনকে চাকরি থেকে বাদ দিতেই হয়, তাহলে একই সঙ্গে তাঁর পদত্যাগপত্রও জমা নিতে হবে। নির্মল সেন যত দিন কারাগারে ছিলেন, তত দিন নিকটজনের কাছে তাঁর বেতন পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেন তিনি।

এমন একজন সাংবাদিক সাহিত্যিক আলোচনার বাইরেই থেকে গেলেন। আহমেদ হুমায়ূন সহকর্মীদের আড্ডায় মাঝেমধ্যেই বলতেন, ‘শাহবাজপুর (তাঁর গ্রামের বাড়ি  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুর) গ্রাম থেকে কাদামাখা পায়ে স্টিলের তোরঙ্গ নিয়ে ঢাকা শহরে পদার্পণ করেছিলাম। রাজনৈতিক কর্মী ছিলাম, শিক্ষকতা করলাম। সাংবাদিকতা পেশায় থেকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তৃতা করারও সুযোগ পেয়েছি। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও সাহিত্য ভালোবেসে কিছু লেখালেখির চেষ্টা করেছি। তাই জীবন নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই।’ ২৩ জুলাই আহমেদ হুমায়ূনের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সাংবাদিক।