প্রত্যক্ষদর্শী

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝপাঝপ লাঠির বাড়ি

Looks like you've blocked notifications!

গল্প কিংবা কলাম নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরোপিত ভ্যাট বাতিল প্রসঙ্গে চলমান আন্দোলন বিষয়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লেখার ক্ষুদ্রতম একটি চেষ্টা। ১০ সেপ্টেম্বর, বৃহস্প্রতিবার। প্রতিদিনের মতোই ঘুম থেকে উঠলাম, ১০টার পরে। মাত্র অফিসের পথে রওনা হয়েছি। সেই মুহূর্তে আমার পরামর্শক কমল ভাইয়ের (বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানী সংবাদকর্মী) ফোন। মোবাইল ফোনে তিনি জানতে চাইলেন, আমি কোথায়। বললাম, মাত্র বাসা থেকে বের হয়েছি..।

এরপর কমল সালাউদ্দিন ভাই যা বললেন, ‘এখনই ধানমণ্ডি ২৭-এ যাও। ওখানকার পরিস্থিতি দেখো। ভালোমতো জানো। তুমি আমাকে আন্দোলনের ফলোআপ দিবা।’ উত্তেজনা সঙ্গে নিয়ে অফিসের দিকে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের (ড্যাফোডিল) সামনে গেলাম। সেখানেই ডিপার্টমেন্টের অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। সবারই একই প্রশ্ন, এতক্ষণ পর...? সহপাঠীদের উৎসাহ আর আন্দোলনের তীব্রতা দেখে অবচেতন মনেই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। রুমি ভাইয়ের সঙ্গে রাস্তা, দেয়াল লিখন আর অবদমিত স্লোগানে গলা মেলালাম।
ততক্ষণে ২৭ নম্বরের চারপাশ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ভারী আর গম্ভীর হয়ে উঠেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। চারপাশ থেকে খবর আসছে ‘রাস্তা ছেড়ো না, আন্দোলন চালিয়ে যাও। আমাদের অধিকার আমরাই আদায় করব।’ ব্যস, বিপ্লবী চেতনা জেগে উঠল। সারাক্ষণই মধ্যবিত্ত পরিবাবেরর সর্বস্ব সঙ্গে নিয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের কথাই ভাবছিলাম। কী হবে, কতটুকু হবে, কতদূর যাবে, আমরা কি পারব...

আন্দোলনের আবহ

কড়া দুপুর। আমরা কাজ করছি। হঠাৎই রুমি ভাইয়ের গভীর তেষ্টা পেল। উনি পাশেই বসে পড়লেন। পানি বলে চিৎকার করলেন। সেই চিৎকার শুনে অপরিচিত একটি ছেলে তার অর্ধেক খাওয়া পেপসির বোতল বাড়িয়ে দিল। এতটা সৌহার্দ্যপূর্ণ কার্যক্রম ছিল আমাদের। কারো মধ্যেই কোনো ক্লেশ ছিল না। এটা ছিল খুবই ভালোলাগার দৃশ্য। আমি ছাত্রটির ব্যবহারে মুগ্ধ হই। পানি আর স্যালাইন খেয়ে আঁকাআঁকির কাজ যখন শেষ, তখন বিকেল ৪টা। পেটে ক্ষুধা, ওদিকে পকেটও ফাঁকা। এবার রানা ভাইয়ের উপস্থিত বুদ্ধিতেই কাজ হলো। স্যারদের থেকে খাওয়ার টাকা নিলাম। সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেলাম।
প্রিন্স প্লাজা (ড্যাফোডিল টাওয়ার-৫) ছেড়ে ধানমণ্ডি ২৭-এ গেলাম। একপাশে পুলিশ, অন্যপাশে আমরা। এমনকি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী দলগুলোর ভেতরেও সাদা পোশাকধারী পুলিশ! দৃশ্যটা দেখেই ফলোআপের ভাবনা ফিরে এলো। নিজে উপস্থিত থেকে এমন পরিস্থিতি জীবনে প্রথম দেখছি। এরকম পরিস্থিতিতে একজন সংবাদকর্মীর ভূমিকায় নিজেকে আবিষ্কার করে আরো উন্মাদনা পাই। সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী হওয়ায় তত্ত্বীয় আর ব্যবহারিক জ্ঞান মিলে যা জেনেছি তা দিয়েই কাজ শুরু করলাম। একে একে তথ্য দিয়ে সহায়তা করলাম কালের কণ্ঠ, এটিএন বাংলা, প্রথম আলো ও বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধিকে।

মূল ঘটনা

সারা দিনের ঘটনা তো সবাই জানেন। যথেষ্ট শান্তিপূর্ণভাবেই আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলন অন্যদিকে মোড় নিল সন্ধ্যায়। বিস্ময়টা সেখানেই, কেন এমন হলো!
দেখলাম, বহিরাগত একটি পক্ষ সাধারণ ছাত্রদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। বলছে ‘আন্দোলন থামান’। তারা একবার ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলছে, আরেকবার পুলিশের সঙ্গে। যদিও পক্ষটিকে সারা দিনের আন্দোলন কর্মসূচির কোথাও চোখে পড়েনি। সন্ধ্যায় তারা এখানে আসে, ছাত্রদের মধ্যে ঢুকে পড়ে। নানা রকম ঘুঁটি চালাচালি করে। এরই মধ্যে ইংরেজি বিভাগের মউ টেলিভিশন চ্যানেলের বুমের সামনে এসে হাজির। মউ বাইট দিচ্ছে। ততক্ষণে পক্ষটির দু-একজনের সঙ্গে কথা বললাম। তারা যা বললো ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখন আর আন্দোলন চালানোর কি দরকার?’ শিক্ষার্থীরা অবশ্য তাদের কথা শোনেনি। অতর্কিত আক্রমণটা কি এ জন্যই হলো? বুঝে ওঠার আগেই হতবিহ্বল হয়ে গেলাম!

ব্যাপারটা অন্যখানে! যেটা বুঝলাম, শিক্ষার্থীরা আসলে নেতৃত্বের অভাবে পড়েছে। এত বড় একটা প্রতিরোধ, অথচ শক্তিশালী নেতৃত্ব নেই। আন্দোলনকারীরা আসলে কাঠামোবদ্ধ হতে পারেনি। সঠিক নির্দেশনা পায়নি। পুরোটা একসময় গোলমেলে হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন মঞ্চ ছাড়তে শুরু করে। হটকারীরাও সুযোগ পেয়ে যায়।

তখন সন্ধ্যা পেরিয়েছে। রাস্তায় মোম জ্বলছে। শিক্ষার্থীদের হাতে তখনো প্লাকার্ড, গলায় স্লোগান। কিন্তু কেউই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। নেতৃত্বের অভাব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। ওদিকে সমঝোতা করতে আসা পক্ষটি হঠাৎই উধাও।

রাত সাড়ে ৮টা, প্রথম আক্রমণ। রাপা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘোরালাম। কী ব্যাপার? এর মধ্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান! ঘাড় ঘুরিয়ে বুঝতে বাকি রইল না। পুলিশি মহড়া পাশ কাটিয়ে একদল (১০-১৫ জন) তরুণ শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকসংখ্যায় কম বুঝে দলটি মুহূর্তেই আবার কেটে পড়ল। কিন্তু না, লোকসংখ্যা কম বলেই নয়। মিডিয়ার ক্যামেরা আর আলোকচিত্রীদের দেখেই তারা সরে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। তাদের চোখে-মুখে নেতৃত্ব আর কার্যকরী নির্দেশনার অভাব। শিক্ষার্থীদের অনেকে আন্দোলন-মঞ্চ ত্যাগ করল।

রাত ৯টা। মোহাম্মদিয়া সুপার মার্কেটের গলি দিয়ে সোবহানবাগ কলোনির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে লাঠি হাতে ২৫-৩০ জন তরুণ। দলটি রাস্তা পার হলো, ফুটপাত ধরে নীরবে চলে এলো রাপা প্লাজার সামনে। দলটি রাপার সামনে থেকে রাস্তা পার হয়ে ২৭ নম্বরের মূল চত্বরের সামনে চলে এলো। এবার তারা আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে আক্রমণ করল শিক্ষার্থীদের ওপর। শিক্ষার্থীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝপাঝপ পড়তে থাকল লাঠির বাড়ি। সবাই দিগ্বিদিক ছুটে গেল। ফাঁকা হয়ে গেল আন্দোলন মঞ্চ, ২৭ নম্বরের মূল চত্বর। আকস্মিক চারপাশে স্থবিরতা নেমে এলো। পুরো দৃশ্যটাই ঘটল দায়িত্বরত পুলিশের সামনে। এখানে প্রতিবাদী শিল্পী মাকসুদের দুটি গানের লাইন রইল- ‘গণতন্ত্র মানে সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে গুলি (লাঠি) চালায়/আর পাশে দাঁড়ানো পুলিশ আনন্দে দেখি নাকে আঙুল চালায়!’ শিক্ষার্থীরা পালালেও আক্রমণকারীর দলটা আরো প্রায় আধাঘণ্টা ২৭ নম্বর ও এর আশপাশের এলাকায় টহল দেয়। এ ঘটনায় আহতের খবর তো মিডিয়ায় রাষ্ট্র হয়েছে, তাই এটা আর নাই বা লিখলাম...

এখন একটা স্লোগানের কথা বলব, যেটা গত বৃহস্পতিবার সারা দিনই শিক্ষার্থীদের গলায়-গলায় ছিল। শিক্ষার্থীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের অন্য স্লোগানের সঙ্গে ছিল এটিও। স্লোগানটা ‘একাত্তরের হাতিয়ার, ভ্যাট বাতিলের জন্য গর্জে ওঠো আরেকবার।’

একাত্তরের স্লোগান ‘জয় বাংলা’। সেই স্লোগানেই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা। ব্যাপারটা কেমন ঘোলাটে! আন্দোলনের ভেতরে ঢুকে কারা এই জাতীয় স্লোগান ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাল। এরা কি আওয়ামী লীগের কেউ? হ্যাঁ, তাই-ই। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারলাম। এই ঘটনার পেছনে যার ইন্ধন রয়েছে, সে শেরেবাংলা নগর থানা যুবলীগের কমিটিতে থাকা একজন প্রভাবশালী নেতা।
লেখাটা আরেকটু দীর্ঘ করব, একটা কারণে। সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করুক বা না-ই করুক, প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিক বা না-ই দিক, অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী অর্থবছর থেকে শিক্ষার্থীরা ভ্যাট দিক বা না-ই দিক, দরকার পড়লে পড়ালেখা ছেড়ে দিক, ভ্যাটের পরিবর্তে ট্যাক্স হোক আর না-ই হোক… সরকারের যা খুশি, তাই-ই হোক, দুর্বৃত্তরা শিক্ষার্থীদের মারুক, আমাদের পরিবার সর্বস্বান্ত হোক… কিছুতেই কিছু বলব না। শুধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটার অপব্যবহার করবেন না। কেউই না। না রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, না শিক্ষার্থী, না, কেউ না। প্লিজ...

লেখক : শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি