ঈদে বাড়ি ফেরা

বাসের টিকেট যেন সোনার হরিণ

Looks like you've blocked notifications!

গত শুক্রবার থেকেই টিকেটপ্রার্থীদের চাপ সামলাতে হতোদ্যোম হয়ে গেছেন টিকেট কাউন্টারের বিক্রেতারা। একই সাথে দৈনন্দিন সার্ভিসও চলেছে সমান তালে, ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে; যাত্রীদুর্ভোগটাই বেড়েছে বহুগুণে। প্রতি বছর এমনি করে ঈদ আসে, ঈদ যায় পরিস্থিতিটা বদলাচ্ছে না কেন। দিনের পর দিন সমস্যার সমাধান না হয়ে যাত্রীদের দুর্ভোগের প্রহরটাই কেন একের পর এক প্রলম্বিত হচ্ছে এ নিয়ে প্রশ্ন হয়েছে অনেক উত্তর মিলছে না। আর প্রশাসনের তরফ হতে সেই একই প্রশ্ন নাজমুল হুদা থেকে ওবায়দুল কাদের একই মুচকি হাসি আর মুখস্থ উত্তর; ঈদ টিকেটের কোনো সমস্যা নাই সবাই শান্তিতে বাড়ি যেতে পারবেন। কিন্তু শান্তি-অশান্তি পরের প্রশ্ন আগে ঈদ টিকেটপ্রাপ্তির নিশ্চয়তাই কেউ দিতে পারছে না।

গতকাল ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বাস টিকেট দেওয়া শুরু হতে না হতেই বেড়েছে হতাশা আর দীর্ঘশ্বাসের চিত্র। একজন ভুক্তভোগী হিসেবে টের পেয়েছি কত ধানে কত চাল, তবে পরম আরাধ্য সে টিকেটটা এখনো হাতে পাইনি। যাবো পাকশীর নতুন রূপপূর। বাড়ির সামনে নামতে হবে বলে চেষ্টা করি অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে হলেও কুষ্টিয়াগামী বাসগুলোতে চেপে বসতে। আজ যথারীতি টিকেট নিতে গেলাম একটু বেলা হওয়াতে তাঁরা বলে দিলেন- ‘ভাই, সন্ধ্যার দিকে আসুন।’ সন্ধ্যায় গিয়ে দ্বিতীয় দফা চেষ্টা করাতে তাঁরা বললেন- ‘ভাই, আজকের মতো টিকেট দেওয়া শেষ কাল সকালে আসুন।’ কিন্তু আমার বুঝে এলো না যে টিকেট নিতে মানুষ এভাবে হন্যে হয়ে ছুটছে তার ক্ষেত্রে কেন সময় সীমারেখা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, নাকি এটাও প্রতারণার নতুন কোনো ফাঁদ?

বন্ধুদের অনেকের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে ন্যায্য মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি টাকা দিয়ে আয়েশে সংগ্রহ করে নিয়েছে তাদের কাঙ্ক্ষিত টিকেট। আর যারা একটু সাহসী-অদৃষ্টবাদী তাদের বিড়ম্বনা শুনে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। এমনি একজন জানাল তার দুর্ভোগের কথা। বিশেষ পরিবহনের টিকেট কিনতে সে সকাল সাড়ে ৭টায় গিয়ে হাজির হয় তাদের মতিঝিল কাউন্টারে। সেখানে বিশাল ভিড় ঠেলে কোনোক্রমে যখন টিকেট কাউন্টারে পৌঁছতে পেরেছে সেখানে গিয়ে জানতে পারে জয়পুরহাটের টিকেট নিতে তাকে আসতে হবে কল্যাণপুর। তারপর দ্রুতলয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে সে রওনা হয় কল্যাণপুর কিন্তু বিধি বাম। সে এসে কল্যাণপুরের কাউন্টারই সরাসরি বন্ধ দেখতে পায়। আশপাশ থেকে নম্বর সংগ্রহ করে সে ফোন করে তাদের কাউন্টার নম্বরে, জানতে পারে টিকেট দিতে পারে গাবতলী থেকে। সে আর সময়ক্ষেপণ না করে গাবতলী গিয়েও বিরক্তির শেষ সীমায় উপস্থিত হয়।

কি আর করা গাবতলী থেকে উক্ত পরিবহনের মহারথী বলছেন টিকেট নাকি দেবে ওই মতিঝিল কাউন্টার থেকেই আর সেটা নাকি শুরু হবে বিকেল থেকে। সকাল পর্যন্ত তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ছিল এই টিকেট দেওয়া হবে গাবতলী থেকেই। পরে যাত্রীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করাতে সিদ্ধান্ত বদলে নিয়ে কর্তৃপক্ষ ভাবছে টিকেট মতিঝিলের কাছাকাছি কাউন্টার থেকেই নাকি দেওয়া হবে। এমনি ঘটনার শিকার হয়েছিলাম আমি নিজেই। গত ঈদে কুষ্টিয়ার বিশেষ একটি বাসের টিকেট সংগ্রহ করতে যাই কল্যাণপুর কাউন্টারে, তারা আমাকে বলে ভাই টিকেট দিচ্ছে সামনে একটা পাম্পের সংলগ্ন কাউন্টার থেকে। দৌড়াদৌড়ি করে যাই ওই কাউন্টারে, তারপর তারা বলল, আমাদের টিকেট শেষ, আপনারা বাকি টিকেট নিতে পারবেন কল্যাণপুর থেকেই। সব থেকে বাজে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির কারণে। এ ক্ষেত্রে একটি কাউন্টার অন্য কাউন্টার থেকে টিকেট কিনে এনে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম না মেনে সরাসরি বিক্রি করে অনেক বেশি দামে। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবহার করা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কিংবা তাদের স্থানীয় প্রভাব। আর এর শিকার হচ্ছে ঢাকার আশপাশে অবস্থিত নানা এলাকা যেমন হেমায়েতপুর, গেন্ডা, সাভার, নবীনগর প্রভৃতি এলাকার মানুষ। তাদের মূল দামের চেয়ে অন্তত দেড়গুণ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে টিকেট।

নিজের বিরূপ অভিজ্ঞতা শেয়ার না করে পারছি না। ট্রেন ভ্রমণে অতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না বলে উত্তরবঙ্গে বাড়ি হওয়ার সুবাদে প্রতিবছর ঈদে দীর্ঘ বাসযাত্রার বিকল্প থাকে না। আর এক একটি ঈদ পার করি, মনে হয় দুর্ভাবনা আর যন্ত্রণার প্রহর যেন দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যেমন কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা বাসের টিকেটগুলো ঠিক ঢাকা-হেমায়েতপুর-সাভার-নবীনগর রুটের দুর্বৃত্তায়ন মডেলে ৫০-১০০ টাকা বেশিতে বিক্রি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই টিকেটের সাথে বাধ্যতামূলক বিক্রি করা হয় র‍্যাফেল ড্রয়ের টিকেট যার দাম হয়তো আরো ২০-৫০ টাকা। তবে এ বছর ঈদের টিকেট দিতে গিয়ে যে বিড়ম্বনার জন্ম দেওয়া হয়েছে তা রেকর্ড সৃষ্টিকারী এবং নজিরবিহীন। বিশেষ করে টিকেট বিতরণ শুরুর মাত্র ১৫ মিনিটের মাথায় টিকেট শেষ ঘোষণা দিয়ে দেওয়া, পাশ থেকে কাউন্টারম্যান ভিন্ন অন্য লোকের বলা ‘চইলা আইসেন ২০০ টেকা বেশি লাগব’, ‘আরে ব্যাপার না যাইতে চান যাইতে পারবেন’, কিছু ধইরা দিয়েন এমন ঘটনা আগে বোধকরি আর ঘটেনি।

এদিকে অনেক কাউন্টার থেকে টিকেট না দিয়ে অনলাইনের সুর তোলা হয়েছে- যা, যাচ্ছেতাই বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। কয়েকটি ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে ঈদের টিকেট কেনার সুযোগ থাকলেও সেখানে একদিন আগে থেকেই সার্ভার ডাউন দেখাচ্ছে। পাশাপাশি ফ্রি থাকা টিকেটগুলোতে ক্লিক করার সাথে সাথে দেখাচ্ছে সেগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে অনলাইন বিশেষজ্ঞদের ধারণা তাদের হয়ত টিকেট বিক্রির এখতিয়ারই নেই। তবে কেন তারা ওয়েবসাইট খুলে বসেছে- এটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা উচিত। আর সব থেকে বড় কথা এ ধরনের ওয়েবসাইটগুলোতে হিট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা টিকেটের মূলো ঝুলিয়ে পাবলিককে দিয়ে হিট করিয়ে নিচ্ছে। তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত হিটটি পাওয়ার পার টিকেটপ্রার্থী দেখছে টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। তাই তারও আর বলার কিছুই থাকছে না। এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেক ওয়েবসাইটেই টিকেট বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানের বিটিআরসি থেকে নিবন্ধনই করা হয়নি।

অনেক বাস কোম্পানি তাদের ওয়েবসাইটেও বিক্রি করছে টিকেট। তবে দেখা যাচ্ছে একই চিত্র, টিকেট বিক্রি শুরু হওয়ার পর থেকে সব টিকেট সোল্ড দেখাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা উচিত তারা কত শতাংশ টিকেট অনলাইনে বিক্রি করছে, কত শতাংশ দিচ্ছে মোবাইলে আর মানুষ কত শতাংশ টিকেট কিনে আনতে পারবে সশরীরে উপস্থিত হয়ে। আর এতগুলো প্রশ্নের উত্তর মেলা ভার, যেখানে টিকেটপ্রত্যাশী মানুষ রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসছে ব্যর্থ মনোরথে। আর সেই সঙ্গে বলে রাখা ভালো অনেক বাস কর্তৃপক্ষ অনলাইনে টিকেট বিক্রির কথা বললেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে তাদের ওয়েবপেইজটিই কাজ করে না, আর নামমাত্র ওয়েবসাইট একটা থাকলেও সেটা লোড হতে হতে আর শেষ পর্যন্ত টিকিট যেখান থেকে বুকিং করা যায় সেই ট্যাব আর আসে না। এহেন অনলাইন-অফলাইন-মোবাইল-সামনা সামনি প্রতারণায় এখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে চাওয়া বেশির ভাগ মানুষের।

প্রয়োজনে প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের শায়েস্তা করার মাধ্যমে মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করতে হবে। অন্তত নির্দিষ্ট সার্ভারের মাধ্যমে সবগুলো টিকেটের প্রাপ্তিযোগ, মূল্য ও গ্রহীতার দাবি মেটানো সম্ভব হলে অন্তত ঈদ টিকেট বিতরণে চিরাচরিত যে দৈন্যদশা তার থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটু তৎপর হয়ে গেলে যারা আগে থেকে টিকেট সংগ্রহ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে, যে প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চমূল্যে বিক্রির আশায় টিকেট আটকে রেখেছে, যেসব অসাধু কর্মচারী বাসের টিকেট কালোবাজারে পাঠাচ্ছে তাদের রুখে দেওয়া সম্ভব। পাশাপাশি মালিকদের পক্ষ থেকে কোনো অহেতুক টিকেট সংকট তৈরির অপচেষ্টা থাকলে প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে তা রুখে দিতে চেষ্টা করতে হবে যোগাযোগ মন্ত্রণায়ের পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ বিভাগকে। আর সবার মিলিত চেষ্টাতেই এ জনদুর্ভোগ রদ করা সম্ভব হবে।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।