শিক্ষা ‘পণ্যায়িত’ বলে কি ভ্যাট আরোপ করা নৈতিক?

Looks like you've blocked notifications!
ফাইল ছবি

আইয়ুব খানের শাসনামল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, এক দেশে দুই ধরনের অর্থনীতি চলছে। রপ্তানির বেশির ভাগ আয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান থাকলেও, বাজেটের সিংহভাগ অংশ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। ‘এক দেশ, দুই অর্থনীতি’র প্রবক্তা রেহমান সোবহান স্যার দেখিয়েছিলেন, কী নির্মম বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘এক দেশে, দুই সমাজ’ বিদ্যমান। একই দেশে, একই অর্থনীতিতে, দুই সমাজ!

অনেক উদাহরণ হয়তো টানা যাবে। আপাতত আমাদের দৃষ্টি শিক্ষাব্যবস্থার দিকেই সীমাবদ্ধ রাখি। দেশে এক হিসেবে দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চলছে। এক ব্যবস্থায় জনগণের করের টাকায় কেউ নামেমাত্র মূল্যে (পড়ুন বিনামূল্যে) পড়ছে। আর কেউ নিজের টাকায় তো পড়ছেই, সঙ্গে উল্টো ওই টাকার করও দিতে হচ্ছে। তেলো মাথায় তেল দেওয়া, শুকনো মাথায় বেল ভাঙার মতো অনেকটা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরোপিত বিশেষ করের নাম - মূল্য সংযোজন কর বা মূসক, ইংরেজিতে ভ্যাট। সাধারণত, বাজারের পণ্যের সঙ্গে এ বিশেষ কর দিতে হয়। প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষা তো পণ্য নয়। সংবিধান মতে, শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। মৌলিক অধিকার গ্রহণ করতে গিয়ে আমাকে কর দিতে হবে কেন? আবার কারো মতে, বেসরকারি উচ্চশিক্ষা এক ধরনের ‘পণ্যায়িত’ শিক্ষা। কেননা, একমাত্র অর্থের বিনিময়েই এ শিক্ষা পাওয়া যায়। সুতরাং, এর ওপর মূসক আরোপ করা চলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বেসরকারি শিক্ষাকে পণ্যায়িত করেছে কে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাত তো অলাভজনক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দৃশ্যত সেসব বর্তমানে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সরকারও তেমনটিই ভাবছে। নয়তো, অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের ওপর করের বোঝা চাপানোর নিয়ম না থাকলেও, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপানো হয়েছে। এর বাইরে টিউশন ফি’র ওপর সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাটের ভার তো রয়েছেই। হ্যাঁ। অনেক যুক্তি দেখিয়ে প্রমাণ করা যাবে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবসার পণ্যের মতোই। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে এখনো অধিকার বলা চলে। কিন্তু এ বেসরকারি উচ্চশিক্ষা তথা ‘পণ্যে’র ওপর ভ্যাট আরোপ করা কি নৈতিক? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ইচ্ছে করেই ভর্তি হচ্ছে না? এমন তো নয় যে, ছাত্ররা ইচ্ছা করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চমূল্যের শিক্ষা নিচ্ছে। বরং, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকটের কারণে আজ দেশের ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বাধ্য হয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। রাষ্ট্র তার নাগরিকের প্রাপ্য অধিকার তথা বিনামূল্যে সরকারি উচ্চশিক্ষা সরবরাহ করতে না পারায়, ওই নাগরিক যদি নিজ থেকে নিজের একটি সংস্থান তৈরি করে নেয় তবে কি তা অপরাধ? যদি তিনি নিজের যা আছে, তা বিক্রি করে জীবনের সবচেয়ে বড় জুয়াটা নিজের সন্তানের জন্য খেলেন, তাতে সরকারের সমস্যাটা কোথায়? শিক্ষার জন্য বাজি ধরা কি অপরাধ?

উন্নত দেশের কথা বাদই দিলাম। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষার্থীরা খুব সহজ শর্তে প্রায় বিনাসুদে ঋণ পায় পড়াশোনার জন্য। নাগরিকদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে বহু প্রচেষ্টা নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। কিন্তু আমাদের দেশে হচ্ছে তার উল্টোটা। বরং, শিক্ষার্থীদের পথে কাঁটা হতে চায় সরকার। যেখানে সরকারের উচিত ছিল, শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাধ্য করা, সেখানে সরকার পীড়কের ভূমিকায় নেমেছে। নৈতিকতার প্রশ্নটি তাই অবধারিতভাবে এসে যায়।

অর্থমন্ত্রী একদিকে বলছেন, কর্তৃপক্ষ ভ্যাট বহন করবে, শিক্ষার্থীরা নয়। অন্যদিকে তিনি শিক্ষার্থীদের ভ্যাট দেওয়ার সামর্থ্য বোঝাতে গিয়ে বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘দৈনিক খরচ ১০০০ টাকা’! সেটার ‘৭.৫ শতাংশ হলো ৭৫০ টাকা’! জানি না, কীভাবে তিনি এত স্ববিরোধী মন্তব্য করতে পারেন! আমি শপথ করে বলতে পারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অনেকেই জমিজমা বিক্রি করে পড়তে এসেছে। ঢাকার মতো কঠোর শহরে জীবন ধারণ করা যে শিক্ষার্থীদের জন্য কত কঠিন, তা তারাই ভালো বোঝে। প্রতি মাসে বাবার ঘাম লেগে থাকা অর্থ চাওয়ার জন্য ফোন দেওয়া তাদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। যে অর্থমন্ত্রী এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন, আমার ভয় হচ্ছে, এ দেশটার আর্থসামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে ওনার কোনো ধারণাই নেই। অর্থমন্ত্রীর মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সবাই ধনী পরিবারের সন্তান! আমার কথাই ধরি। আমি এ ঢাকা শহরে সপ্তাহে প্রায় ৫০ ঘণ্টা চাকরি করে নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালাই। এসব কি অর্থমন্ত্রী বোঝেন? আমরা যদি ধনী হই, তবে উনি ও ওনার সহকর্মী সংসদ সদস্যরা কি দরিদ্র? ওনারা ট্যাক্স ছাড়া গাড়ি এনে রাস্তায় হাঁকাবেন। পারলে ওই গাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ব্যবসা করবেন। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করবেন। ওনাদের জায়গা করে দিতে আমাদের ভিড়ওয়ালা বাস যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকবে। এরপরও আমাদেরই ট্যাক্স দিতে হবে! অর্থমন্ত্রী বললেন, বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য আর কোনো খাত নেই। এ জন্যই এ খাতে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হবে না। আচ্ছা, এ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কয় টাকাই ওনার আসবে? ওনার কাছে তো চার হাজার কোটি টাকাও ‘তেমন বড় কিছু নয়’। ওনাদের হলমার্ক, শেয়ারবাজার, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অমুক ব্যাংক-তমুক ব্যাংক, থোক বরাদ্দে লুটপাটের কারণে বাজেটে যত ঘাটতি হবে, সেসব পূরণ করতে হবে আমাদের?

মোবাইল ফোনে খরচের ওপর আগে থেকেই ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। নতুন করে সর্বশেষ বাজেটে ৩ শতাংশ সারচার্জ যুক্ত করা হলো। কোনো প্রতিবাদ না হওয়ায় নতুন করে আরো ১ শতাংশ যুক্ত করার প্রস্তাব চলছে। শিক্ষার্থীদের ওপর ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট যে আগামীকাল ১৫ শতাংশ হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী? সব কিছু মিলিয়ে ছাত্ররা যখন আন্দোলনে নামল, তখন অনেক সমালোচনা গজিয়ে উঠছে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবিশেষের প্ল্যাকার্ডের বিষয়বস্তু নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিপক্ষের শক্তি যখন প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছিল না, তখন শাহবাগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ‘আচরণ’, ‘মাদক সেবন’, ‘নারী-পুরুষের খোলামেলা অবস্থান’ ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে সত্য-অর্ধসত্য-মিথ্যা তথ্য দিয়ে সমালোচনা শুরু করেছিল। অথচ আন্দোলনের মূল সুর ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। পরবর্তী সময়ে হয়তো ওই আন্দোলন বিভিন্ন কারণে সফল হয়নি। কিন্তু অঙ্কুরেই একে ব্যর্থ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা এখন আমাদের মনে পড়ছে। যারা মুখের ওপর ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলনের বিরোধিতা করতে পারছেন না, তারাই এসব অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলছেন। মনে রাখতে হবে, এ আন্দোলন কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে না। শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্বার্থে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেরাই এখানে অংশ নিচ্ছে। ঢাকা শহরের ছয়-সাতটি স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে এ আন্দোলন হচ্ছে। ফলে একটি বা দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে আন্দোলনের মূল সুরের প্রতিনিধিত্ব করে না, সেটি বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। বরং, আন্দোলনের ব্যাপকতা বিবেচনায় আরো অনেক ভুল আমি আশঙ্কা করেছিলাম, যা আদতে হয়নি। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন গুলি খেল, তখনই আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠতে পারত। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে চিন্তা করুন সেখানে। সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠত পরিস্থিতি। সুতরাং, বলা যেতে পারে, এ আন্দোলন আশঙ্কার চেয়েও অনেক কম ভুল করেছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, সানি লিওন, নাস্তিক-আস্তিক ইত্যাদি বিরক্তিকর বিতর্ক পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। নাগরিকরা এখন ভাবতে শুরু করেছে, এ ভ্যাট বা কর কাদের দেওয়া উচিত। এসবের উৎস কী? এসব অর্থ যাচ্ছেই বা কোনো খাতে। এ বিষয়টিই হয়তো এ আন্দোলনের অন্যতম বড় সফলতা। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বা ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আন্দোলন করতে ভুলেই গিয়েছিল। নিজেদের স্বার্থ ও অধিকার নিয়ে আন্দোলন করার ‘ট্রেন্ড’ আবারও জাগিয়ে তুলেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আন্দোলন যখন তুঙ্গে- এনবিআর, অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী একযোগে ঘোষণা দিলেন, ভ্যাটের অর্থ বিদ্যমান টিউশন ফির মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেবে। এ বক্তব্য বা ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য বড় তিনটি যুক্তি আছে শিক্ষার্থীদের। প্রথমত, অর্থনীতি যে লোকটি একেবারেই বোঝে না, সে-ও জানে, ভ্যাট বা কর ভোক্তার কাছ থেকেই চূড়ান্তভাবে আদায় হয়। ডিম মুরগির মালিক দেবে না, মুরগিকেই দিতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু শিক্ষার্থীদের অর্থেই চলে, সুতরাং করের অর্থও শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ঘাড়েই পড়বে। এনবিআরের এ ধরনের ব্যাখ্যা কার্যত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেওয়ার প্রচেষ্টা। সমালোচকদের যুক্তি, যে অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাচ্ছে, সে অর্থ যদি সরকার পায়, তবে শিক্ষার্থীদের সমস্যা কী? শিক্ষার্থীদের শঙ্কা হলো, সরকারকে যদি ভ্যাট দিতেই হয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্ভাব্য দুটি কাজ করবে। প্রথমটি হলো, যেকোনো উপায়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই ওই ভ্যাট আদায় করা হবে। হতে পারে কোনো এক নতুন খাত দেখিয়ে আরো বেশি অর্থ আদায় করা হবে। দ্বিতীয়টি হলো, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিদ্যমান সুবিধা হ্রাস করা হবে। যেমন, মানসম্মত শিক্ষকদের সংখ্যা কমানো হতে পারে, বা শিক্ষার্থীদের অন্য কোনো সুবিধা কমিয়ে ফেলা হতে পারে। দুটোই কিন্তু শিক্ষার্থীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। যদি নিশ্চিত করা যেত যে, শিক্ষার্থীদের অর্থ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শিক্ষাতেই ব্যয় হচ্ছে, তবে কথা ছিল না। কিন্তু এখন তো শিক্ষা ব্যবসায়ীরা নিজেদের ভাগ ঠিক রাখতে গিয়ে, শিক্ষার্থীদের ভাগের বারোটা বাজাবেন।

অনেকে বলছেন, সরকারের বিরুদ্ধে নয়, শিক্ষার্থীদের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা উচিত। খুবই ভালো যুক্তি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি যদি পাঁচ টাকা বাড়ানো হয়, তবে আন্দোলনে ভাঙচুর হয় পাঁচ কোটি টাকার সম্পদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক সম্মানিত শিক্ষক আমাকে নিজ মুখে এসব বলেছেন। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কার সম্পদ ভাঙচুর করবে? এসব তো শিক্ষার্থীদের নিজেদেরই অর্থে গড়া! সেখানকার মালিকরা সরকারি আমলাদের মতো স্লথগতির নন। দুই দিনেই বের করে ফেলবেন, কে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে বা উসকানি দিয়েছে। কার হাতে ভাঙচুর হয়েছে। ঠিক তার বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের হবে। দু-তিন লাখ টাকা যখন এরই মধ্যে খরচ করে কোনো শিক্ষার্থী স্নাতক কোর্সের মাঝসমুদ্রে অবস্থান করছে, তখন তার পক্ষে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে গিয়ে ছাত্রত্ব হারানোর ঝুঁকি নেওয়া সহজ নয়। এ জায়গায় সরকারের সক্রিয়তা প্রয়োজন ছিল। আমরা বলছি না, মালিকপক্ষ ঢের ভালো। তারাও নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে বা ব্যবসায়িক স্বার্থেই বিশ্ববিদ্যালয় চালান, এটি খুবই সত্য কথা। কিন্তু সরকার কী করছে? তাদের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করার বদলে, সরকার সেখান থেকে কমিশন চায়, বখরা চায়। আমি শুনেছি, ছিনতাইকারীরও নিজের ছিনতাইয়ের মালের একটি অংশ গডফাদারকে দিতে হয়। সরকার এখানে গডফাদারের ভূমিকা নিতে চায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর নয়। এখানেই আপত্তিটা।

একবার এক সেনাপতি যুদ্ধ হেরে গেলেন। রাজা প্রশ্ন করলেন, সেনাপতি, তুমি কেন যুদ্ধে হেরেছো? সেনাপতির জবাব, মহারাজ, আমি এ জন্য ১০১টি কারণ দেখাতে পারি। রাজা চ্যালেঞ্জের সুরে বললেন, দেখাও তোমার ১০১টি কারণ। সেনাপতি বললেন, প্রথম কারণ – আমার সব গোলা পানিতে পড়ে ভিজে গেছে! রাজা বললেন, থাক! তোমার আর বাকি ১০০টি কারণ দেখাতে হবে না। ওপরের এতগুলো যুক্তি দেখানোই আমার বৃথা হলো। কেননা, অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের দ্বিতীয় সংস্করণে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ভ্যাট প্রথম বছর মালিকপক্ষ দিলেও পরের বছর থেকে শিক্ষার্থীদের দিতে হবে।’ তাঁর বক্তব্যের তৃতীয় সংস্করণও এরই মধ্যে দেখা গেছে। তবুও আশা করি, এবার ছাত্রদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা বা শঙ্কার যৌক্তিকতা নিয়ে কারো মনে প্রশ্ন নেই।

অধিকারের জন্য আন্দোলন এ দেশে হয় না। যখন হলো, তখনো এক পক্ষের ভালো লাগল না। রাতের আঁধারে কাপুরুষের মতো কিছু চিহ্নিত গুণ্ডাপাণ্ডা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেরে উঠিয়ে দেওয়া হলো। পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখছিল। এমনকি ভয় পেয়ে অপ্রস্তুত ও ‘অপেশাদার’ শিক্ষার্থীরা যখন পালাতে গেল, তখন অপরপাশ দিয়ে আটকাল পুলিশ। এক পুলিশ সদস্য তখন বলছিল, ‘(ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য শব্দে সম্বোধন), কই যাস! সারাদিন তো অনেক আন্দোলন দেখাইছিলি! এখন পালাস ক্যান?!’ ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছোড়ার বিষয়টি শুনেছি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালোভাবে নেননি। তাই নিজেদের আড়ালে রেখে পুলিশ সন্ত্রাসীদের দিয়েই তাদের সন্তানের বয়সী ছেলেদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। তবুও আড়াল রাখতে পেরেছেন কই? একপর্যায়ে তারাই ছাত্রদের তাড়িয়ে উঠিয়েছেন রাস্তা থেকে।

জয় হোক এ নতুন ছাত্র আন্দোলনটির, নতুন এ নাগরিক আন্দোলনটির। এ ধরনের আন্দোলন যত বেশি হবে, তত বেশি জনগণের অধিকার সুরক্ষিত হবে। ইস্যু হতে হবে সরাসরি জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট, রাজনীতিকদের ব্যক্তি-স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয়। তবেই দেশ আগাবে। স্বচ্ছতা আসবে। রাষ্ট্রে নাগরিকদের ভিত শক্তিশালী হবে। নাগরিকদের তাই কিছুটা কষ্ট সহ্য করে হলেও, এ আন্দোলনে সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়া উচিত। নতুন কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুনেছি, অনেকের সন্দেহ, আন্দোলনে শিক্ষার্থী সংখ্যা যাতে কম থাকে, এ জন্যই কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে ক্লাস বন্ধ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব কি আদৌ কাজে আসবে? আমাদের এখন আরেকজন রেহমান সোবহান লাগবে, যিনি আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন, বৈষম্যটা ঠিক কোথায়।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী

Email: nazmulahasan@live.com