অভিমত

সাংবাদিকের ডিজিটাল নিরাপত্তা

Looks like you've blocked notifications!

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্বেগ নতুন কিছু নয়। এই ধারার সর্বশেষ শিকার হয়েছেন সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ—যিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টাসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে ফেসবুকে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। সেই তথ্যের সত্য-মিথ্যা যাই থাকুক না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলার পেছনে যে তাঁর সাম্প্রতিক এই স্ট্যাটাসগুলো অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ কম।

তবে এসব আইনি উদ্বেগের ভেতরে যে বিষয়টি আড়ালে থেকে যায়, তা হলো ডিজিটাল ডিভাইসের নিরাপত্তা। অর্থাৎ আমরা যে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব, কম্পিউটার ইত্যাদি ব্যবহার করি, সেগুলোই বা কতটুকু সুরক্ষিত?

আমরা যে যন্ত্রগুলো ব্যবহার করি, সেগুলো কীভাবে চলে, অর্থাৎ তার টুলগুলো জানা দরকার। আমরা যখন মোবাইল ফোনে কথা বলি, তখন এটি ফোনের ওপারে আরেকজনের ফোনে সংযুক্ত হওয়ার আগে অন্তত একটি জায়গায়, অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আর্কাইভ অতিক্রম করে। ফলে সেখানে সব তথ্যই সংরক্ষিত থাকে। আবার গ্রাহকরা সব সময়ই নজরদারির ভেতরে থাকে। চাইলে এই ফোন কলগুলো তৃতীয় কেউ রেকর্ডও করতে পারে।

ফলে এই আশঙ্কাও আমাদের মনে থাকে যে, আমাদের ফোনকল কি রেকর্ড হচ্ছে? এসএমএস কি অন্য কেউ পড়ছে? ফেসবুক মেসেঞ্জারে আমরা যেসব তথ্য ও ছবি আদান-প্রদান করছি, তা কি তৃতীয় কেউ পড়ছে বা দেখছে? এসব উদ্বেগ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা ৫৭ ধারার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদিও ডিজিটাল ডিভাইসের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের ভাবনাটা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বলে প্রতীয়মান হয়।

বাস্তবতা হলো, ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ঝুঁকিও বাড়ছে। বিশেষ করে সাংবাদিকদের ঝুঁকি অনেক বেশি। কেননা, তাঁদের অনেক স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজ করতে হয়। ফলে অনেক সময় তাঁরা বিভিন্ন বাহিনীর নজরদারিতেও থাকেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি।

২.

ইন্টারনেট ও মোবাইল অ্যাপসে সবেচয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ইত্যাদিতে তথ্য আদান-প্রদানের পরিমাণ বাড়ছে এবং সংগত কারণেই এসব মাধ্যমে ঝুঁকিও বেড়েছে। বিশেষ করে সাংবাদিকদের এসব ঝুঁকির বিষয়ে এখন অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়। মোবাইল ফোনে কথা বলা এবং এসএমএস আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হয়। সাংবাদিক তাঁর গোপন সূত্রের সঙ্গে কীভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করবেন এবং একই সঙ্গে তাঁর সোর্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তথ্য সংগ্রহ করবেন, সেই কৌশল নিয়েও এখন আমাদের কথাবার্তা বলা ‍উচিত।

তবে শুধু বাইরে নয়, কর্মক্ষেত্রেও সাংবাদিককে তাঁর ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে সতর্ক থাকা দরকার। কেননা, সব অফিসেই এখন সিসি ক্যামেরা থাকে। ফলে কেউ যখন নিজের মোবাইল ফোন বা পিসিতে পাসওয়ার্ড টাইপ করেন, তখন সেটি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে কেউ, বিশেষ করে আইটির লোকজন দেখতে পারেন কি না—তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে সব অফিসের নীতি বা পলিসি এক নয়। তবে সম্ভবত কোনো প্রতিষ্ঠানই তার সহকর্মীদের ব্যক্তিগত পাসওয়ার্ড হ্যাক করা বা জানার চেষ্টা করে না। তবে সব সহকর্মীর মানসিকতা যেহেতু এক নয়, সে কারণে অফিসের টেবিলে নিজের মোবাইল ফোন ফেলে রেখে যাওয়া, কম্পিউটারে কাজ শেষে সেটি লগ আউট করা,  অফিসের কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহার করলে সেখানে রিমেম্বার পাসওয়ার্ড অপশন চালু না রাখা এবং প্রতিবার ব্যবহারের সময় লগ ইন ও লগ আউট করার মতো ছোট ছোট সাবধানতা বিপত্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। অনেক সময় ঘাড়ের পেছনেই আপনার কোনো সহকর্মী থাকতে পারেন। ফলে পাসওয়ার্ড দেওয়া এবং গোপনীয় কিছু লেখার আগে ভালো করে খেয়াল করুন ঘাড়ের পেছনে কেউ আছে কি না।

৩.

ইন্টারনেটে নানা রকম অফার ও সুযোগের প্রলোভনে পা দিয়ে আমরা বুঝে না বুঝে অসতর্কভাবে অনেক জায়গায় নিবন্ধ করি। সেখানে নিজের ই্-মেইল তো বটেই, অনেক সময় ফোন নম্বরও দিতে হয়। এটা সব সময় সুখকর নাও হতে পারে। মনে রাখা দরকার, ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি বা অপব্যবহারের সুযোগ সবচেয়ে বেশি। সুতরাং এসব প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত হতে গিয়ে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যগুলো তাদের দিয়ে দিচ্ছি এবং সেই তথ্য কে কখন কোথায় কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে, তা আমরা জানি না। এসব প্রতিষ্ঠান মূলত নিবন্ধনের নামে মানুষের তথ্যভাণ্ডার বা ডাটাবেস গড়ে তোলে এবং সেই তথ্য বিক্রি করে।  এমনকি এসব তথ্য জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ব্যবহারও অসম্ভব নয়। সুতরাং ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার যেমন জরুরি, তেমনি এটির ব্যবহার ও অপব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক থাকা আরো জরুরি। সব সময় সবখানে নিবন্ধিত হওয়ার নামে ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে দেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

মোবাইল ফোনে বিভিন্ন অ্যাপস ইনস্টলের মধ্যে ভেরিফিকেশন চাওয়া হয়, ভেরিফিকেশন কোড দেওয়া হয়—এসবও কোথাও না কোথাও সংরক্ষিত থাকে এবং কে কখন এটি কী কাজে লাগাবেন, বোঝা মুশকিল। বলা হয়, প্রয়োজনের বাইরে প্রযুক্তির অতি ব্যবহারও মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

আমরা ব্যক্তিগত ও তথ্যের নিরাপত্তার জন্য নানা রকম সুরক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকি। যেমন এমন কোনো অ্যাপ, যা দিয়ে কথা বললে বা তথ্য আদান-প্রদান করলে সেটি তৃতীয় কেউ নজরদারি করতে পারে না। কিন্তু এই সিকিউরিটি মেজার বা সুরক্ষা পদ্ধতি একদিকের হলে লাভ নেই। বরং যে দুজন তথ্যের আদান-প্রদান করছেন, তার কোনো একজনের সুরক্ষা পদ্ধতি দুর্বল হলে তথ্য ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। যেমন আপনি জিমেইল বা ইয়াহুর চেয়ে প্রটোন মেইলকে অধিকতর নিরাপদ ভেবে কাউকে প্রটোন মেইল দিয়ে তথ্য পাঠালেন। কিন্তু যাকে পাঠালেন, তিনি প্রটোন মেইল ব্যবহার করেন না। সুতরাং এই একপাক্ষিক সতর্কতার কোনো মূল্য নেই।

ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ই-মেইলে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড দেওয়া এবং ডিজিটাল ডিভাইসগুলোতেও শক্তিশালী পাসওয়ার্ড দেওয়ার ওপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বলা হয়, এখন কয়েকটি বর্ণে বা শব্দে পাসওয়ার্ড দেওয়ার চেয়ে কোনো একটি ফ্রেজ অনেক বেশি শক্তিশালী। যেমন একটা সময় পর্যন্ত 123 এ রকম পাসওয়ার্ড ব্যবহারের প্রবণতা ছিল। অনেকে নিজের নামের প্রথম বা শেষাংশ, নিজের সন্তানের নাম, পছন্দের খাবার বা স্থান ইত্যাদি পাসওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, এটি যথেষ্ট নয়। বরং এখন শক্তিশালী পাসওয়ার্ড হতে পারে কোনো একটি ফ্রেজ, যেটি আপনি সহজে মনে রাখতে পারেন। কিন্তু তৃতীয় কেউ কখনো ধারণাই করতে পারবে না যে আপনি এ রকম পাসওয়ার্ড দিয়েছেন। ফলে সেটি সহজে হ্যাক করাও যাবে না। যেমন কোনো একটি কবিতার লাইন অথবা লম্বা একটি বাক্য, যেটি আপনি সহজেই মনে রাখতে পারেন।

তবে ডিজিটাল ডিভাইসের এসব সুরক্ষার পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহারেও সতর্ক থাকা, বিশেষ করে অন্যের সম্মানের প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। ফেসবুকে যেহেতু কোনো সম্পাদক নেই, গণমাধ্যমের মতো এখানে কোনো গেটকিপার নেই—তাই ফেসবুক ব্যবহারকারী নিজেই তার নিজের সম্পাদক। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘মার্জিনে মন্তব্য : গল্পের কলকব্জা’য় লিখেছেন, ‘আপনি কী লিখবেন, সেটি যেমন জরুরি, তেমনি কী লিখবেন না সেটি আরো জরুরি।’ ফেসবুকে মন চাইলেই যা ইচ্ছে তাই লেখা বা কারো চরিত্র হনন কিংবা ব্যক্তিগত আক্রমণ চলতে থাকলে এসব প্রতিরোধ ও প্রতিকারে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার যৌক্তিকতা জোরালো হয়। বিশেষ করে সাংবাদিকদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস যেহেতু অনেক বেশি—তাই একজন গণমাধ্যমকর্মী চাইলেই যা খুশি লিখতে পারেন না।

লেখক : সাংবাদিক।