তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়...

Looks like you've blocked notifications!

তখনও হালকা শীত। একটু একটু কুয়াশা। দুই হাতের দশ আঙুল বগলে চেপে হাঁটছি, যেন ওই শীতটুকুকেই চেপে ধরেছি। উষ্ণতা দিতে পারে এমন কাপড় খুব কম পরতাম। তা লোক দেখানোই বলা যায়। অল্প বয়স। শীত করলেও তার শিরশিরানি লুকিয়ে রাখার বয়স। বরং খুব শীতেও কেউ গরম কাপড় পরলে তাঁর দিকে তাচ্ছিল্য ছুড়ে দিতাম। বলতাম—কই আমার তো লাগে না!

কিন্তু শীত লাগত। বাড়ি চট্টগ্রামে হলেও আমার শৈশব কেটেছে দর্শনায়, কেরুর মদ আর চিটাগুড়ের গন্ধে! সন্ধ্যার পর বোন, মা-বাবার সঙ্গে যাচ্ছি উত্তম কাকাদের বাসায়। মিল চালু থাকলে কোম্পানির বড় গেইট পেরিয়ে, মিলের ভেতর দিয়েই সর্বশেষ গেইট পেরিয়ে গরম জলের ফোয়ারার ছিটেফোঁটা গায়ে মেখে বাজারপাড়ার দিকে চলে যাওয়া যায়। নইলে আনন্দবাজার ঘুরে যেতে হয়। মিলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে টের পাওয়া যেত নানা গন্ধ। যেন দু’কদম পর পর নতুন কোনো গন্ধ নাকে এসে হরিবোল বলোহরি বলছে! কাঁচা আখের গন্ধ, গরু-মহিষের গোবরের গন্ধ, ট্রাক্টরের টায়ার পোড়ানোর গন্ধ আর কালোরঙা কী জানি এক তেলের গন্ধ, ওষুধের গন্ধ, জলের উষ্ণ প্রস্রবণের গন্ধ, চিটাগুড়, মদ ইত্যাকার নানা গন্ধে মেশা ছিল আমার শৈশব।

সেসব রঙিলা গন্ধ পেরিয়ে আমরা উত্তম কাকাদের কোয়ার্টার-ঘরে পৌঁছালাম। বড়রা গল্প করছে। বোনও ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আর আমি সাদাকোলো টেলিভিশনে বিটিভি দেখছি। সেই শৈশবেও মনে মনে অস্থির ছিলাম। কিন্তু ওই যে বললাম, একটু লোকদেখানো ভাব ছিল, তাই চুপচাপ থাকার ভান করতাম। কেরু স্কুলে প্রথম-টোথম হতাম। সে জন্যই হয়তো!

উত্তম কাকাদের ঘর ছিল রাস্তা-লাগোয়া। আখবোঝাই গরুর গাড়ির চাকার মচমচে আওয়াজে আমাদের নাড়ি নড়ে উঠত। কখনো-সখনো দৌড়ে যেতাম। পেছন থেকে টান দিতাম লম্বা-আস্ত আখ। একটু রাতও হয়েছে। টেলিভিশন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালাম। আখ টানতে ইচ্ছে হলো না। একটু হাঁটলেই বড় মাঠ, যেখানে প্রায় শুক্রবারই ফুটবল খেলা হতো, এক কর্নারে দাঁড়ালাম। সারি সারি কোয়ার্টার-ঘরগুলোর কোনো একটি থেকে বেরিয়ে এলো—‘তুমি কেন বোঝো না, তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়’...

আমার চোখের সামনে সেই মুহূর্তটি এখন ছায়াছবির মতো ভেসে উঠছে। ভেসে উঠছে—মাঠে দাঁড়িয়ে আমি সেই সুরের উৎস খুঁজছি, সমস্ত কোয়ার্টার-ঘরের বাতিজ্বলা জানালা দেখছি, কিছুটা ফিকে হয়ে কানে আসা বেহালার সুরে মন কেমন হয়ে উঠছে! জানি না, ওই বয়সে ‘সেই তুমি’ কেন ‘অচেনা’ হলো তার মর্মে পৌঁছানোর সক্ষমতা ছিল কি না। কিন্তু মনে আছে, রাতে যখন আমরা আবার নানা গন্ধ পেরিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছি, তখন একটু শীত লাগছে, বুকের ভেতর হু হু করে উঠছে। মনে পড়ছে, গত বৈশাখী উৎসবে যেমন খুশি তেমন সাজো অনুষ্ঠানে কেন রিমুকে তাঁর বাবা আমার বৈষ্ণবী সাজতে দেননি? আমার বুকে তখন ‘চলো বদলে যাই’ চরণটি হুড়মুড় করে বাজছিল কি না, আজ মনে নেই!

কানাপুকুর পেরিয়ে বাংলোপাড়ায় থাকত রিমুরা। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে যেমন খুশি তেমন সাজোয় আমরা সাজতাম। কখনও একতারা হাতে বাউল, কখনও বৈষ্ণব, আবার কখনও সারা গায়ে কাদা মেখে হাতে হাতবোমা রাখা মুক্তিযোদ্ধা-ভাস্কর্য হতাম। সে এক মজার দিন ছিল। আমার সহপাঠী ছিল রিমু। ফর্শা, শুকনো শরীরের সেই রিমুর মুখ এখন আর স্মরণে নেই। শুধু মনে আছে, ওর চুল ছোট ছিল, ডানহাতে ঘড়ি। বাংলোপাড়ায় যাঁরা থাকতেন, তাঁদের মতোই অভিজাত। আর আমরা যাঁরা অন্য পাড়ার, তাঁরা যেন ফুটপাত থেকে গরম কাপড়ের খরিদ্দার। চেয়েছিলাম, আমার বৈষ্ণবী সাজবে রিমু।

সেইমতো পাড়ার দাদা-কাকুরা রিমুর বাসায় যেতে বললেন। বড় মসজিদ, বড় বড় গাছের গুঁড়ি আর কানাপুকুর পেরিয়ে একে-ওকে জিজ্ঞেস করে রিমুদের কোয়ার্টারে পৌঁছালাম। কে দরজা খুলেছিল মনে নেই। ওর বাবার দাড়ির কথা মনে আছে। তখন আমরা ছোটরা ওরকম দাড়িওয়ালা লোক দেখলে সমস্বরে ‘চুটকি চুটকি দাড়ি, চুয়াডাঙ্গা বাড়ি’ বলে ছুট দিতাম। বিস্কিট, ফল আর শরবত দিয়েছিল বোধহয়। খাইনি। রিমুর বাবা বলেছিলেন, বৈষ্ণবী সাজা হবে না। কী প্রচণ্ড মনখারাপ নিয়ে যে বাংলোপাড়া থেকে হেঁটে হেঁটে টেডিকোয়ার্টারে ফিরেছিলাম!

মনে আছে, পরদিন স্কুলে রিমুকে দেখলাম দূরে-দূরে থাকতে। আমি ওর কাছে গেলাম। কিছু বলছে না। তবু ওকে জিজ্ঞেস করলাম, সাজবে না? রিমু বলল, আব্বু বলেছে, বোষ্টমী না কি হিন্দু!

ওই রাতে স্কুলের পাশে কেরুর পেছনের গেইট পেরিয়ে যখন বাবার হাত ধরে নানা গন্ধ নিতে নিতে হাঁটছিলাম, তখন বুকের ভেতর ওই দূর থেকে শোনা ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ চরণটি বাজছিল। মনে পড়ছিল, বোষ্টমী হিন্দু বলে রিমু আমার সঙ্গে সাজবে না; যদি পুরস্কার পাই, আমরা একসঙ্গে অনির্বাণ থিয়েটারের মঞ্চে উঠব না!

সেই প্রথম প্রত্যাখ্যানের দিন, সেই প্রথম অপমানবোধ জেগে ওঠার দিন আমাকে আজও তাড়া করে ফেরে—‘যতবার ভেবেছি ভুলে যাব/ তারও বেশি মনে পড়ে যায়/ ফেলে আসা সেইসব দিনগুলো/ ভুলে যেতে আমি পারি না’...

আমাদের শৈশব-কৈশোরে ব্যান্ডের রমরমা অবস্থা। পুরো দেশে বাজত জেমস-হাসান-বাচ্চু ত্রয়ীর গান। এ প্রজন্মের কেউ ভাবতেই পারবে না, একটি অডিও অ্যালবাম বেরোলে কী উচ্ছ্বাস, কী সাড়া পড়ে যেত পাড়ায়-পাড়ায়। ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘সে তারাভরা রাতে’... দিনজুড়ে বাজত ঘরে ঘরে। শীতকালে ফেদার খেলার সময় রাতজুড়ে বাজত মাঠে। ফিতা আটকে গেলে থুতু দিয়ে মুছে ইকোনো কলম ঢুকিয়ে ফের ক্যাসেট সারানোর কারিগর ছিলাম সব্বাই।

আজও জীবন মেরামত করতে না পারলেও ক্যাসেট মেরামতকারী বানানোর প্রশিক্ষকদের একজন শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। আজ রুপালি গিটার ফেলে হুট করেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি। আমাদের শৈশব-কৈশোর ও উঠতি যৌবনের নায়ক আইয়ুব বাচ্চু। আমাদের হৃদয়ে থেকে যাবেন তিনি। বাংলাদেশের হৃদয়ে থেকে যাবেন তিনি। ঈশ্বর মঙ্গল করুন গানের নায়ককে!