ক্রিকেট

সিলেট টেস্ট আগামীর উৎসবে শোকের ছায়া

Looks like you've blocked notifications!

টেস্ট ক্যাপ্টেন হিসেবে মাহমুদউল্লাহ খুব লাকি। আপনার মনে হতে পারেই রসিকতার জন্য এই কথাটা লেখা। সে রকম কিছু ভাবলে ভুল হবে। হ্যাঁ, শুধু ভুল নয়। মারত্মক ভুল হবে। সত্যিই তো মাহমুদউল্লাহ ভাগ্যবান।

ক্রিকেটে ক্যাপ্টেন্সি এমন একটা জিনিস, যেখানে পান থেকে চুন খসলে সমালোচনা হবে। আরো মোটাদাগে বললে বলতে হয়, ক্যাপ্টেন্সি করলে সব সময় গালাগাল খাওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হয়। কিন্তু জিম্বাবুয়ের কাছে সিলেট টেস্ট সাড়ে তিন দিনে হারার পর বাংলাদেশকে নিয়ে কে কী সমালোচনা করবেন। কেন করবেন? ক্যাপ্টেন রান পাননি। বড়জোর এটুকু। ব্যস। তা ছাড়া আর কী বলতে পারবেন তাঁর ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে। তারপরও মুখিয়ে থাকা সমালোচকরা যা একটু বলার সুযোগ পেতেন, তা আর পেলেন কোথায়? মিডিয়া লাইভ করছে রাজনীতির নির্বাচনী ম্যাচ। খবরের কাগজের প্রথম পাতাজুড়ে জোট-মহাজোট-ঐক্যফ্রন্ট-যুক্তফ্রন্ট, সমাবেশ-সংলাপের বড় বড় শিরোনাম। তার মাঝে কোথায় আর সিলেট টেস্ট।

তবে না। রাজনীতির কারণে মাহমুদউল্লাহ বেঁচে গেলেন সিলেট টেস্টে ও রকম হারের পর, এটা ঠিক না। মাহমুদউল্লাহকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে সেখানে অনেককে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু কে দাঁড়াবেন? কাকে দাঁড় করাবেন? জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ডের মতো দেশের বিপক্ষে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জিতলে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের মঞ্চে লোক দাঁড়ানোর জায়গা সংকুলান হয় না। কিন্তু সিলেট টেস্টের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে দেখা গেল শুধু বোর্ডের স্থানীয় এক পরিচালক আর স্পন্সরের একজন প্রতিনিধি, কারণ হারের সাক্ষী হিসেবে কেউ ক্যামেরাবন্দি হতে চাইলেন না। এটাই খুব স্বাভাবিক। সাফল্যের দাবিদার, ভাগিদার অনেক। কিন্তু ব্যর্থতা বড়ই এতিম। তাই সেখানে দায়টা শুধুই বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের। সাড়ে তিন দিনে ১৫১ রানের বিশাল হারের পর টেলিভিশনের সামনে প্রথম কৈফিয়তটা দিতে হলো সেই বাংলাদেশ অধিনায়ককে। আর ব্যাখ্যার মোটামুটি সারমর্ম : ব্যাটসম্যানরা ঠিকঠাক ব্যাট করতে পারলেন না। শুধু এই টেস্টে নয়, গত কয়েকটা টেস্টে আমাদের দল ভালো ব্যাট করতে পারছে না।

টেলিভিশনে মাহমুদউল্লাহর কথা শোনার পর মেলবোর্ন থেকে দুবাইয়ে উড়ে আসা এক ভদ্রলোককে মোবাইলে কল করেছিলাম। ভদ্রলোকের দুবাই নম্বরে বার কয়েক রিং হলো। কিন্তু ও প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া এলো না। তার ঘণ্টাখানেক পর ইউএইর কোড নম্বর জোড়া একটা ফোন নম্বর থেকে কল এলো। সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর। ‘কল করেছিলেন। ধরতে পারিনি। মিটিংয়ে ছিলাম। তাই...।’ এরপর স্বাভাবিকভাবেই চলে এলো জিম্বাবুয়ের কাছে বাংলাদেশের হার প্রসঙ্গ। ভদ্রলোক খুব পরিষ্কার বললেন, ‘হেরেছে। কিন্তু এই হারের জন্য খেলোয়াড়দের সমালোচনা করা ঠিক না। টেস্ট শুরুর আগেই বাংলাদেশ ম্যাচটা হেরে বসেছিল । আর টেস্ট শুরুর পর থেকে কখনো মনে হয়নি বাংলাদেশ এই টেস্টটা জিততে পারে।’ নিজের এই যুক্তির ব্যাখ্যাটা দিলেন তিনি। ‘গত শতাব্দীতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে চলে যাওয়া ফরমুলা যদি আপনি একুশ শতকে প্রয়োগ করেন, তা হলে ম্যাচ জেতার আশা করা যায় না। যা হওয়ার তাই হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে ক্যাপ্টেন আর ক্রিকেটারদের কর্মপরিধি ঠিক করা আছে। তাদের ম্যাচ জেতাতে হবে। বাকি কারো কোনো কর্মপরিধি ঠিক নেই। কার কাজ কে করছেন, সেটাও কেউ জানেন না! তবে নির্বাচকদের এখন আমি আর দোষ দিতে চাই না। নান্নু ভাই, হাবিবুল ওরা বড়জোর কিছু নাম দিতে পারেন। সেই নামগুলো থাকবে, সেই গ্যারান্টি তাঁরা দিতে পারবেন না। সেই নামগুলো থাকে বলেও মনে হয় না। বাংলাদেশ ক্রিকেট ব্যবস্থাপনায় সবাই সবকিছু করতে চান। করেন। একইভাবে এই আধুনিক জমানায়ও বাংলাদেশ তিন ফরম্যাটেই একই খেলোয়াড়কে খেলাতে চাইছে। এটা হতে পারে না। খুব সহজ কথায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের চিন্তনপ্রণালি নিয়েই প্রশ্ন ভদ্রলোকের। আর তাঁর নাম? আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ১৮ বছর আগে বাংলাদেশের যখন টেস্ট খেলার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, সে সময় এ রকম এক নভেম্বরের ১১ তারিখ টেস্ট ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়েছিলেন তিনি। সেটা এখন স্মৃতির সৌধ। কিন্তু সেই সৌধের উচ্চতা ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আর বাংলাদেশের কারো সামনে নেই।

সিলেটের অভিষেক টেস্টের বুকে দগদগে ক্ষত হয়ে রইল বাংলাদেশের হার। এই হারের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আপনি আপনার মতো করতেই পারেন। তবে এই টেস্ট অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এলো। টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে সত্যিই কি আমাদের দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা আছে? আপাত উত্তর—না। ব্যাটসম্যানরা খেলতে পারেননি, এই কথাটাকে সামনে এনে বাকি সবকিছু আড়াল করা সহজ হয়ে যাচ্ছে! টিম কম্বিনেশন কি ঠিক ছিল? কী উত্তর দেবেন? কে দেবেন? উত্তরদাতা হতে হবে ক্যাপ্টেন মাহমুদউল্লাহকে। যিনি হয়তো শুধু টস করতে নামার আগে একটা প্লেয়ার লিস্ট হাতে পেয়েছিলেন! প্রকৃতির ছোঁয়া লাগা সিলেট মাঠের সবুজ আউটফিল্ড মুগ্ধ করবে আপনাকে। আপনার চোখের জন্যও দারুণ তৃপ্তিদায়ক। কিন্তু তার মাঝখানের বাইশ গজ। ন্যাড়া। ধূসর। টেস্টের প্রথম দিনে যা দেখে অস্বস্তি বাড়াবে যেকোনো ক্রিকেটপ্রেমীর। সেই ধূসর জায়গায় কিছুটা রঙের ছোঁয়া লাগিয়ে রাখলেন বাংলাদেশ দলের এক স্পিনার তাইজুল ইসলাম। ১১ উইকেট নিলেন তিনি। নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স। কিন্তু তার সেই কীর্তি উৎসবের মেজাজে উদযাপন করা গেল না। ম্যাচ শেষে তিনিও পরাজিত দলের সদস্য! দলের সবচেয়ে শোকাহত ব্যক্তিও বোধ হয় তিনি।

আগামীতে যদি কোনো দিন সিলেট টেস্ট ভেন্যুর পঁচিশ, পঞ্চাশ বা শত বর্ষপূতি উদযাপন করার জন্য কোনো স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ হয়, সেখানে মাহমুদউল্লাহর টস করতে যাওয়ার ছবিটা থাকবে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সবচেয়ে উজ্জ্বল ছবি হিসেবে হয়তো থাকবে তাইজুলের ছবিটা। তবে সিলেট স্টেডিয়ামের টেস্ট অভিষেকের রজতজয়ন্তী, সুবর্ণজয়ন্তী বা হীরকজয়ন্তী পালনের সময় উৎসবের রঙটা হারিয়ে গিয়ে শোকজয়ন্তীর রূপ নিতে পারে। যখন স্মৃতির কোনায় উঁকি দেবে জিম্বাবুয়ের কাছে ১৫১ রানের হার।

বিসিবি অনুমোদিত বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের কোনো সরকারি ইতিহাস গ্রন্থ যদি কোনোদিন লেখা হয়, আর সেখানে যদি নির্মোহ বিশ্লেষণ থাকে, তাহলে একটা কথাই বেরিয়ে আসবে। আঠারো বছর টেস্ট ক্রিকেটে পার করেও বাংলাদেশ তার ‘জাতীয় ক্রিকেট নীতি’ প্রণয়ন করতে না পারায় জিম্বাবুয়ের কাছে সতেরো বছর পর নিজের মাটিতে খুব বাজেভাবে হার। সেখানে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা খোঁজা শর্ট কাভার থেকে দৌড়ে এক্সট্রা কাভারের দিকে গিয়ে বাউন্ডারি বাঁচানোর চেষ্টা।

ফুটনোট : বাংলাদেশের ইতিহাসে সিলেটি অর্থমন্ত্রীদের দাপট বেশি। তাই রসিকজনরা বলাবলি করছেন, সিলেট টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা বেশি রান করতে চাননি ।বেশি রান করলে যদি আবার রানের ওপর অর্থমন্ত্রী ট্যাক্স ধার্য করেন!

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জানার্লিস্ট ও কলামিস্ট।