রাজনীতিতে ‘মামুর জোর’ ও পরিবারতন্ত্র

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশ শুধু নয়, প্রতিবেশী ভারত, এমনকি সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতেও পরিবারতন্ত্র আছে। ভারতে নেহরু-গান্ধী পরিবার, যুক্তরাষ্ট্রে বুশ ও কেনেডি পরিবার, চীনের চিয়াং পরিবার, নেপালে থাপা, জাপানে ফুকুদা, দক্ষিণ কোরিয়ায় পার্ক ও উত্তর কোরিয়ায় কিম পরিবার। এভাবে দেখা যাবে পৃথিবীর সমস্ত দেশ, এমনকি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও এক বা একাধিক পরিবারের প্রভাব রয়েছে। যেমন বাংলাদেশে শেখ ও জিয়া পরিবার। ভারতের রাজনীতিতে নেহরু-গান্ধীর বাইরে আরো অনেক পরিবারের লোকেরা যুগের পর যুগ নানা পদে ছিলেন এবং আছেন। শ্রীলংকায় ৮০টির বেশি পরিবারের নাম জানা যায়, যাদের রাজনীতিতে নানা রকম প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে।

বাংলাদেশে বৃহৎ দুই পরিবারের (শেখ ও জিয়া) বাইরে ছোট ছোট পরিবারতন্ত্রেরও জন্ম হয়। বিশেষ করে স্বামী এমপি হলে তার মৃত্যুর পরে তার স্ত্রীই যে এমপি হবেন, সেটি এখন অলিখিত নিয়ম। সবশেষ আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তা তাঁর আসনে এমপি হয়েছেন। যদিও জয়া সেনগুপ্তা নিজেও এই পদের যোগ্য।

আওয়ামী লীগের বিতর্কিত এমপি আবদুর রহমান বদি (ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তিনি ‘ইয়াবা বদি’ নামে পরিচিত) জীবিত থাকলেও এবার ছিটকে পড়েছেন মনোনয়ন থেকে। সাম্প্রতিক মাদকবিরাধী সর্বাত্মক অভিযান চলাকালীন তিনি ওমরাহ পালনের কথা বলে দেশ ছাড়েন। তবে বদি এবার নৌকার টিকেট না পেলেও তাঁর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তাঁরই স্ত্রী শাহিন আক্তার চৌধুরী। বদির স্ত্রী এমপি মানে নেপথ্যে মূলত এমপি যে বদি নিজেই, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক চলে না। ফলে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নানা আলোচনা হচ্ছে।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হত্যা মামলায় কারাবন্দি টাঙ্গাইল-৩ আসনের এমপি আমানুর রহমানও এবার নৌকায় বসার জায়গা পাননি। অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, এবার তিনি মনোনয়ন পাবেন না। কিন্তু যথারীতি এখানেও পরিবারের ঘেরাটোপ থেকে রাজনীতির মুক্তি মেলেনি; বরং এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন আমানের বাবা আতাউর রহমান খান। ফলে বদি ও আমানের ক্ষেত্রে বিষয়টা যে লাউ সেই কদু কি না, সেই প্রশ্নও ফেসবুকে লোকজন ছুড়ে দিচ্ছেন।

এবার এই পরিবারতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছে খুলনা-বাগেরহাট এলাকায়। সেখানে শেখ পরিবারের তিনজন প্রার্থী। বাগেরহাট-১ আসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলালউদ্দিন, পাশের বাগেরহাট- ২ আসনে শেখ হেলালের ছেলে শেখ সারহান নাসের তন্ময় এবং খুলনা-২ আসনে শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল। তিনি শেখ হেলালের ভাই।

এ তিনটি আসনসহ সারা দেশে এবার শেখ পরিবারের প্রার্থী মোট আটজন। তাঁরা হলেন এই পরিবারের বর্তমানে প্রধান প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা (গোপালগঞ্জ-৩ ও রংপুর-৫), বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল করিম সেলিম (গোপালগঞ্জ-২), বঙ্গবন্ধুর আরেক ভাগ্নে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ (বরিশাল-১), বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির বড় ছেলে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস (ঢাকা-১০), বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীর বড় ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরী (মাদারীপুর-১) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

তবে এবার আলোচনায় এসেছেন পটুয়াখালী-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এস এম শাহজাদা। তিনি বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার ভাগ্নে। অনেকেই এটি বলার চেষ্টা করছেন যে তিনি সিইসির ভাগ্নে বলেই মনোনয়ন পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে এই আসনে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের এমপি আ খ ম জাহাঙ্গীর বেশ অভিমান ও আক্ষেপের সুরে বলেছেন, ‘আমার তো মামা নাই।‘ ‘সিইসির ভাগ্নে’র বাইরে শাহজাদার আর কোনো পরিচয় নেই বলেও মন্তব্য করেন আ খ ম জাহাঙ্গীর।

গণমাধ্যমের খবর অবশ্য বলছে, আ খ ম জাহাঙ্গীর নানা কারণেই বিতর্কিত হয়েছেন। ফলে এবার তিনি এমনিতেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতেন না। পটুয়াখালী-৩ আসনে তিনি একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় তিনি সংস্কারপন্থি হিসেবে চিহ্নিত হন এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি। পরে অবশ্য আ খ ম জাহাঙ্গীরকে ফিরিয়ে আনা হয়। তবে স্থানীয়রা মনে করেন, এ আসনে এবার এস এম শাহজাদার নৌকার টিকেট পাওয়াটা নিশ্চিত হয়েছে আ খ ম জাহাঙ্গীরের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণেই। তা ছাড়া অনেক আসনে নতুন মুখ দেওয়া এবং উচ্চ মহলের তদবির—দুটি বিষয়ই তার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করা হয়।

পরিবারতন্ত্র এবং খুঁটির জোর সব দলেই আছে। যেমন এবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমান দণ্ডিত হওয়ার কারণে নির্বাচন করতে না পারলে তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে তারেকের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানকে নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এ দুজন না থাকলে পরিবারের বাইরে অন্য কেউ যে দলের হাল ধরতে পারেন বা শীর্ষ নেতৃত্বে আসতে পারেন, সেই ভাবনাটাই যেন কারো মাথায় নেই।

এই পরিবারের আরো যারা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দার, নীলফামারী বিএনপির সভাপতি প্রকৌশলী শাহরিন ইসলাম তুহিন এবং খুরশীদ জাহান হক উল্লেখযোগ্য। পরিবারতন্ত্রে পিছিয়ে নেই জাতীয় পার্টিও। দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের পাশাপাশি স্ত্রী রওশন এরশাদ, ভাই জি এম কাদের, বোন মেরিনা রহমান রাজনীতিতে অবস্থান শক্তিশালী করেছেন। ভগ্নিপতি প্রয়াত ড. আসাদুর রহমানও জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। বিদিশাকে বিয়ে করার পর তিনিও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। তবে এরশাদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে বিদিশা আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেননি।

পরিবারতন্ত্রের কারণে সব সময় যে অযোগ্যরাই রাজনীতিতে আসেন, এমনও নয়। বরং নিজের যোগ্যতায়ও অনেকে আসতে পারেন। সেখানে পারিবারিক পরিচয় তাঁকে বাড়তি কিছু সুবিধা দেয় বৈকি। উদাহরণ হিসেবে আমরা চট্টগ্রামের সাবেক সিটি মেয়র এবং আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে নওফেলের কথাই ধরি। তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। স্মার্ট এই তরুণ নিজেকে এতটাই যোগ্য-দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন যে রাজনীতিতে তিনি নিজের পরিচয়েই চলতে পারেন। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন।

পরিবারতন্ত্রের কিছু সুবিধাও আছে। যেমন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে বহুধাবিভক্ত ও বিশৃঙ্খল আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করে দীর্ঘদিন পরে হলেও ক্ষমতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কারণেই।

জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরে কোনো বিকল্প চিন্তা না করেই তখন তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয় এবং সংগত কারণেই এটা ভাবা সমীচীন যে তখন খালেদা জিয়া বা এই পরিবারের বাইরে অন্য কেউ বিএনপির নেতৃত্বে এলে দলটি কয়েক টুকরো হয়ে যেত এবং বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারত বলে মনে হয় না।

বাস্তবতা হলো, যে দল বা যে ব্যক্তি জনগণের কাছে একবার পরীক্ষিত বা যিনি একবার জনপ্রতিনিধি হয়েছেন, আলোচনা-সমালোচনা বা বিতর্ক যাই থাকুক, দলের ভেতরে এবং নির্বাচনী এলাকায় তাঁর একটা প্রভাব থাকে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও ওই দল ও ব্যক্তির ব্যাপারে একটা আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয়।

তাহলে পরিবারতন্ত্রের সমস্যাটা কোথায়? এককথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে অনেকগুলো অসুবিধার মধ্যে একটি এ রকম যে, কোনো এলাকায় বা আসনে পরিবারতন্ত্র শক্তিশালী হলে সেখানে অন্য পরিবারের যোগ্য লোকেরা ছিটকে পড়েন বা তাঁরা রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেন না। কারণ সবাই জেনে যায়, ওই পরিবার থেকেই প্রার্থী দেওয়া হবে। ফলে তাঁরা রাজনীতিতে খুব বেশি ডেডিকেশন দিয়ে কাজ করেন না। আবার মানুষও জানে, ওই পরিবার থেকেই কেউ না কেউ পাবে। ফলে তারাও ঘুরেফিরে ওই পরিবারে লোকেদের কাছেই যায়। তৃণমূলে গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার পথে একটি বড় বাধা এই পরিবারতন্ত্র।

কিন্তু পরিবারতেন্ত্রের বিরুদ্ধে কখনো প্রকাশ্যে এবং জোরেশোরে কোনো কথা হয় না। শুধু কিছু বামপন্থি সংগঠন এবং কিছু বুদ্ধিজীবী কালেভদ্রে এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। যেহেতু দেশের প্রধান দুটি দলই পরিবারতন্ত্র জিইয়ে রেখেছে এবং আগামীতেও রাখবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, ফলে কেউ এ বিষয়ে আওয়াজ তুললেও তা হালে পানি পায় না। এবার বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তাঁর ছেলে তারেক রহমানের নির্বাচনে অংশ নেওয়া একেবারেই অনিশ্চিত এবং বোঝা যাচ্ছে যে অসম্ভবও। কিন্তু তাতেও এবার যে জিয়া পরিবারকে একেবারে বাদ দিয়েই বিএনপি নির্বাচন করবে, তা হয়তো নয়। শেষ মুহূর্তে হয়তো দেখা যাবে, এই পরিবারের কেউ না কেউ ভোটের মাঠে আছেন এবং রাজনীতিতে তাঁর কোনো অবদান, কোনো অভিজ্ঞতা কিংবা জনসম্পৃক্ততা না থাকলেও পারিবারিক পরিচয়ের কারণেই তিনি একসময় দলের শীর্ষ নেতায় পরিণত হবেন। তার মানে হলো, রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র এমন একটি প্রপঞ্চ, যেটি ঘুরেফিরে এবং বহু বছর পরে হলেও সে ফিনিক্স পাখির মতো পুনরুজীবিত হতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক।