নিরাপত্তা

অস্ট্রেলিয়ার শঙ্কা অমূলক কি?

Looks like you've blocked notifications!

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দল নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে যখন আসন্ন বাংলাদেশ সফর পেছাল, আমরা যেন শৈশবে ফিরে গেলাম। আমাদের ভাবখানা ছিল এমন- ভয় পেয়ে মানইজ্জত খোয়ানোর ভয়ে বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে না অস্ট্রেলিয়ায়। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তাদের অজুহাত মাত্র। যদিও আমরা ভুলে গেছি, অস্ট্রেলিয়া ওই সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে কেবল টেস্ট খেলবে। ক্রিকেটের ‘ওয়ান ডে’ সংস্করণে আমরা ভীষণ শক্তিশালী বটে। কিন্তু টেস্টেও আমরা সমান শক্তিশালী, এ কথা বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে পাগলাটে ভক্তের কাছেও অত্যুক্তি মনে হবে। তবুও অসংখ্য ট্রলে ছেয়ে গেছে ফেসবুক। জাতি হিসেবে আমরা বেশ রসিক। অনেক গুরুগম্ভীর বিষয়েও মজা করার সুযোগ পেলে ছাড়ি না। হয়তো নিত্যনৈমিত্তিক রাশভারী খবর শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা। তাই ট্রল করেই ভারি বাতাস হালকা করার চেষ্টা করি। 

তবে সবাই অতটা রসিক নন, কেউ কেউ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বিষয়টিকে। এদের বেশির ভাগই অস্ট্রেলিয়ার সফর পেছানোর পেছনে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ধ্বংস করার ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজে পেয়েছেন। জগমোহন ডালমিয়া মারা যেতে না যেতেই অস্ট্রেলিয়ার এমন সিদ্ধান্ত। এন শ্রীনিবাসনের কোনো কূটচাল নয়তো? অনেকে স্বভাবগতভাবে এবারও অভিযোগের আঙুল তাক করেছেন পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে জঙ্গিবাদের উত্থানের দিকে। কিন্তু এঁরা ভুলে গেছেন ২০১১ সালেই একবার বাংলাদেশ সফর করে গেছে অস্ট্রেলিয়া। সে সফরের দুই বছর আগে বাংলাদেশে সর্বশেষ সরকার পরিবর্তিত হয়।

অস্ট্রেলিয়ার এ সিদ্ধান্ত নিয়ে একটু ভাবলেই কিন্তু আমাদের পিঠ বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাওয়ার কথা। আমরা নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব কিছুই বেশ হালকাভাবে নেই। বাংলাদেশিদের প্রাণ দুনিয়ার সবচেয়ে কমদামি প্রাণের অন্যতম।

লঞ্চডুবিতে মরলে ছাগল দিয়ে আমাদের তুষ্ট রাখা যায়। গুম, অপহরণ, পেট্রলবোমা কয়েকদিন আগেও আমাদের সমাজের ‘স্ট্যাটাস কু’ ছিল। এই তো সেদিন সন্তানের সামনে মাকে ধর্ষণের প্রতিবাদে শামিল হওয়ায় তিনজনকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করল। এবার তাদের ভাগ্যে ছাগলও জুটল না। বরং ৭০০ ‘অজ্ঞাতনামা’ ব্যাক্তির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে। বিদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লিখলেন, সুইডেনের মুরগির চেয়েও কমদামি বাংলাদেশিদের লাশ। মিথ্যে বলেননি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানরাও তাদের নাগরিকদের ওভাবেই দেখে, তা ভাবলে মস্তবড় ভুল হবে। 

অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কদিন আগে নিজেদের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ সফরে আগ্রহী অস্ট্রেলিয়ানদের জন্য নতুন সতর্কবার্তা যুক্ত করে। সেখানে বলা হয়, নির্ভরযোগ্য তথ্য রয়েছে যে সম্ভবত বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান স্বার্থে হামলা চালানোর পরিকল্পনা আঁটছে জঙ্গিরা। নাগরিকদের চলাফেলার সীমিত করার পরামর্শ দেওয়া হয় ওই বার্তায়। ক্রিকেটাররা নিশ্চয়ই অধিকতর সংবেদনশীল নাগরিকদের একটি দল। তাই তাঁদের নিয়ে অস্ট্রেলিয়া সরকারের অতিরিক্ত উদ্বেগ থাকাটাই কি স্বাভাবিক নয়?  

অনেকে সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘হঠাৎ’ করে অস্ট্রেলিয়া কেন এমন প্রশ্ন তুলছে। অস্ট্রেলিয়ার ইন্টিলিজেন্স নিয়েও প্রকারান্তরে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আমরা কি ভুলে গেছি, ২০০৮ সালে এই অস্ট্রেলিয়াই পাকিস্তান সফর বাতিল করেছিল? এর কয়েক মাস পরেই কি ২০০৯ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের ওপর হামলা হয়নি? এক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার নেওয়া সিদ্ধান্ত কি সঠিক প্রমাণিত হয়নি তখন? সুতরাং তাদের ইন্টিলিজেন্সকে খাটো করার বেলায় আমরা দু’বার ভাবছি না কেন? আর বাংলাদেশই বা কী করছে? বিপিএলে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমরা পাকিস্তান নামের নরকে আমাদের সাকিব-তামিমদের পাঠাতে চেয়েছি। পরে ওই সফর ঠেকাতে উচ্চ আদালতের নির্দেশ প্রয়োজন হয়েছিল। তবেই টনক নড়েছিল বিসিবির। এখনো বোর্ড সালমাদের পাঠাতে উঠে পড়ে লেগেছে। সুতরাং, আমাদের নিক্তিতে অস্ট্রেলিয়াকে মাপা উচিত বলে মনে করি না। আমাদের উচিত আরো একধাপ সতর্ক হওয়া যাতে পাকিস্তানের মতো কোনো ঘটনা বাংলাদেশে না ঘটে।

অস্ট্রেলিয়ার সতর্কবার্তায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ সফরে উচ্চমাত্রার সতর্কতা গ্রহণের পরামর্শ থাকলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামে সফর না করার পরামর্শ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অপহরণ ও বিভিন্ন সহিংসতাকে অন্যতম ঝুঁকির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ যুক্তিও একেবারেই ফেলনা নয়। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলোর পারস্পরিক সংঘাতে বহু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া এর আগেও বিদেশিদের অপহরণ করা হয়েছে সেখানে। এর ফলে সেখানে পর্যটন সম্ভাবনা নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে উল্লেখ না করলেই নয় যে, এ আঞ্চলিক দলগুলোর কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সুসম্পর্ক রয়েছে। পাহাড়ে সহিংসতা ও অপহরণের ঝুঁকি নিরসনে অস্ট্রেলিয়াও তাই সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারত। 

ওদিকে গতকাল অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রায় হুবহু এক সতর্কবার্তা সংযোজিত হয়েছে ব্রিটেনের সরকারি ওয়েবসাইটে। সেখানেও পশ্চিমা স্বার্থে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া কথিত ‘ফাইভ আইজে’র সদস্য। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত এ জোট নিজেদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি করে। তাই অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনেরও সতর্কবার্তায় এ সাদৃশ্যকে কাকতালীয় না ভাবাই শ্রেয়। কিন্তু ব্রিটেন একটু অন্য ধরনের একটি তথ্যও সন্নিবেশিত করেছে, যা অস্ট্রেলিয়া নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেনি। ব্রিটেন বলেছে, সিরিয়া ও ইরাকে চলমান সংঘাত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠী পশ্চিমা স্বার্থে আঘাত হানতে পারে। সোজা কথায় বলতে গেলে, আইসিসর প্রতি সহানুভূতিশীল গোষ্ঠীকেই হুমকি মনে করছে পশ্চিমারা। এখানে স্মরণ রাখা যেতে পারে, এ মাসেই সিরিয়া ও ইরাকে আইসিস জঙ্গিগোষ্ঠীর ওপর বিমান হামলা শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া। যুক্তরাজ্য অনেক আগ থেকেই সক্রিয়ভাবে আল-কায়েদা, তালেবান কিংবা হালের আইসিসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে বহু হিসাব-নিকাশ কষে মাঠে নামতে হয়েছে। তাই তাদের আশঙ্কাকে অমূলক ভেবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

গতকাল রাতে এক ইতালিয়ান নাগরিক দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাও নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করেছে। ওদিকে ওই ইতালিয়ান নাগরিককে হত্যার দায় জঙ্গি গোষ্ঠী আইসিস স্বীকার করেছে বলেও খবরে এসেছে। এসব কিন্তু আমাদের জন্য ভালো খবর নয়। তবে এখনো আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ইতালিয়ান নাগরিক নিহত হয়েছে ছিনতাইকারীদের হাতেই। গুলশান-২ এলাকাটি অনেকদিন ধরেই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তবে নিশ্চিত করে কেইবা বলতে পারে? তদন্তে হয়তো বেরিয়ে আসবে সত্য। 

কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশের কিছু রাজনীতিকের বক্তব্যের শব্দচয়ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তারা সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করেছেন ‘জঙ্গি’ শব্দটি। অস্ট্রেলিয়া যখন জঙ্গি হামলার আশঙ্কাতেই সফর পেছাল, তখন তাদের খুশি হওয়ার উপলক্ষ তৈরি হয়েছে বলেই মনে হয়। কিন্তু না! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বললেন, অস্ট্রেলিয়ার আশঙ্কা অমূলক। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা প্রধানের সঙ্গে বৈঠকেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা জানালেন হামলা হতে পারে এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপনও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সমর্থন করেছেন। দুই শিবিরের দুই আসাদুজ্জামান সম্ভবত এ প্রথম কোনো বিষয়ে একমত হলেন। কিন্তু আদৌ কি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি নেই? কয়েকদিন আগেও ব্লগারদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সে ক্ষেত্রেও কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই দায় স্বীকার করেছে। জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে থাকা রাষ্ট্র ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র কিন্তু একই বিশেষণ নয়। তাই একাধারে শান্তিপূর্ণ উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ‘রিব্রান্ডিং’ করা যেমন জরুরি, তেমনি জঙ্গি ভাবাপন্ন গোষ্ঠীগুলোকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়াটাও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা প্রসারেরও কোনো বিকল্প নেই। আর এ স্পর্শকাতর ইস্যুটি নিয়ে রাজনীতি করা হলে রাষ্ট্রই প্রকারান্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক সময় জাতীয় ‘মর্যাদা’র চেয়ে জাতীয় নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি গুরুত্ব দিলে, জাতীয় মর্যাদা এমনিতেই অর্জিত হবে। আর গণতান্ত্রিক চর্চাকে দুর্বল করলে অগণতান্ত্রিক ও জঙ্গিবাদী শক্তিই শূন্যস্থান দখল করবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।