১৪ ডিসেম্বর

একাত্তর ও ক্রান্তিকালের বুদ্ধিজীবী

Looks like you've blocked notifications!

বুদ্ধিজীবী ও সিভিল সমাজ বা সিভিল সোসাইটি বললে একটা সময় পর্যন্ত যেসব মানুষের মুখ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠত—সেইসব মুখ এখন অনেকটাই ম্লান। জাতির ক্রান্তিলগ্নে যে মানুষগুলো নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে সাহসিকতার সঙ্গে সত্য কথাটি বলবেন এবং জাতিকে পথ দেখাবেন—তিনিই বুদ্ধিজীবী। কিন্তু কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে হতাশার সুরেই লিখতে হয়েছিল, ‘বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ।’ আরেকটু ক্ষোভের সঙ্গে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে লিখতে হয়েছিল, ‘বুদ্ধিজীবীরা এখন বিভক্ত তিন গোত্রে; ভণ্ড, ভণ্ডতর, ভণ্ডতম।’

এ রকম একটি সময়ে আমরা পালন করছি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আমরা স্মরণ করছি আমাদের সেইসব পূর্বপুরুষকে, যাঁরা সত্যিকারেই জাতির আলোকবর্তিকা ছিলেন। যাঁদের নাম শুনলে ভিন্ন আদর্শের, ভিন্ন মত ও পথের মানুষটিও দাঁড়িয়ে যেতেন সম্মানে। আমরা সেই মানুষগুলোকে স্মরণ করছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক দুদিন আগে এক ভয়াবহ পরিকল্পনায় যেই আলোকবর্তিকাদের নির্মমভাবে খুন করা হয়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁদের মরদেহ ফেলে রেখে যায়। অবশ্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বর যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, তখন তাদের প্রথম শিকারও ছিলেন এই বুদ্ধিজীবীরা। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের শুরু ও সমাপ্তি হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়েই। যার উদ্দেশ্য ছিল খুব পরিষ্কার, যাতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এই জাতি সহজে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের মেরুদণ্ড বোধ করি এখনো ওই অর্থে সোজা হয়নি।

এর একটা বড় কারণ, আমাদের বুদ্ধিজীবী ও সুশীলরা নানাভাবেই নিজেদের বিতর্কিত করেছেন। সেই সুযোগে সরকারও তাদের কোমর ভেঙে দিয়েছে। দেশে এখন বস্তুত সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী সমাজ বলে কিছু আর অবশিষ্ট আছে কি না, সে প্রশ্ন তোলাই সংগত।

২০০৭-০৮ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সুশীলদের একটি অংশ ছিলেন। ফলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে নানা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যখনই নাগরিকদের কোনো অংশ নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন, যা সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েছে; তখন সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ যেমন লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট বা তাত্ত্বিক সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বাক্যাক্রমণের শিকার হয়েছেন।

সিভিল সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবীদের অভিন্ন করে দেখায় কেউ কেউ গোস্বা হতে পারেন। কেননা সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ বলতে সেখানে অধিকারভিত্তিক বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনকেও বোঝায়। কিন্তু বুদ্ধিজীবী বললে সেখানে শুধুই ব্যক্তিকে বোঝায়। যেমন শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ইত্যাদি। কিন্তু এখানে আমরা সিভিল সমাজ ও বুদ্ধিজীবিতাকে অভিন্ন বলে বিবেচনা করছি এর কাজের বিবেচনায়। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী ও সিভিল সমাজের কাজই হলো সরকারকে রাইট ট্র্যাকে বা সঠিক পথে পরিচালিত করা। সরকার যদি স্বৈরাচার বা গণবিরোধী হয়ে ওঠে, সেখানে প্রথম প্রতিবাদটা আসার কথা এই সিভিল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকেই। তাদের মাধ্যম হতে পারে সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বক্তৃতার মঞ্চ ইত্যাদি। আর জনগণের কাছে এই নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের গ্রহণযোগ্যতা এমনই পর্যায়ে থাকবে যে তারা যখন কোনো একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন, তখন সেই বিষয়টি নিয়ে খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রও ভাবতে বাধ্য হবে। কিন্তু এখন কোনো ইস্যুতে কিংবা গত এক দশকে আমাদের সিভিল সমাজ বা বুদ্ধিজীবীরা কি এমন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন যা সরকারের নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে? আমাদের মাথার ওপরে এমন কোনো অভিভাবক আছেন, যিনি নির্ভয়ে সত্য কথাটি বলতে পারেন? যদি থাকেন তাহলে সেই সংখ্যাটি কত এবং তাদের সেই কথার কতটুকু দাম দেয় এই সমাজ ও রাষ্ট্র?

বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ শিক্ষক। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন যোগ্যতায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হয়, কে বা কারা উপাচার্য হন বা হতে পারেন—তা কমবেশি সবার জানা। সুতরাং এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে কারো পক্ষেই আসলে ওই অর্থে সিভিল সোসাইটি বা বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়।

সুশীল বা বুদ্ধিজীবী বলে আমরা যাঁদের চিনি জানি, তাঁদের অনেকেই কোনো না কোনো সরকারের তল্পিবাহক হয়ে সুবিধা নিয়েছেন। যেমন নানাবিধ ব্যবসার লাইন পেয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন, বিভিন্ন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন, গণমাধ্যমের লাইসেন্স পেয়েছেন বা অন্য কোনো উপায়ে সুবিধা পেয়েছেন। সিভিল সোসাইটির ব্যানারে নানা রকম ফোরাম থাকলেও তাঁদের অনেকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অনুকূলে কাজ করেন। অনেকে আজকাল সরাসরি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাও হন।

কয়েক বছর ধরেই যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা হলো, গালাগালি আর হুমকি-ধমকির ভয়ে কিংবা কখনো ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা এবং কিছু নগদ সুবিধার লোভে বুদ্ধিজীবীরা মানে সুশীল সমাজের লোকেরা এমন কোনো বিষয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন না, যা সরকারের কোনো বড় সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে। কিছু লেখক-শিক্ষক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাঝেমধ্যে কথা বলেন টক শোতে, সংবাদপত্রে লেখেন; কিন্তু অনেক সময়ই তাঁদের একটা ভয় বা শঙ্কার ভেতরে থাকতে হয়। ফলে অনেকের কথাবার্তাই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’। আবার তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষীরাও অনেক সময় তাঁদের সব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলা বা লেখায় নিরুৎসাহিত করেন। বলেন, ‘সময় ভালো না।’ এই সময় ভালো না অজুহাতে অনেক সময় নাগরিক সমাজ বা সুশীল সমাজ কিংবা বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নীরব থাকেন অথবা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে এমনভাবে কথা বলেন, যা আসলে কোনো পূর্ণাঙ্গ অর্থই তৈরি করে না। ফলে আমরা একদিকে বলি আমরা খুব গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছি; অন্যদিকে নাগরিক সমাজের কেউ কোনো সমালোচনা করলে তার গায়ে বিশেষ কোনো দলের বা গোষ্ঠীর তকমা লাগিয়ে দিই। ফলে এই সিল খাওয়ার ভয়েও অনেক সময় সিভিল সোসাইটি চুপ থাকে।

আকবর আলি খান জানান, ‘বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সিভিল সমাজের প্রকৃত ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। এক ঘরানার দার্শনিকেরা বলেন, সিভিল সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে সমাজে ঐকমত্য গড়ে তোলা। প্রতিদ্বন্দ্বী ঘরানার দার্শনিকেরা বলেন, সিভিল সমাজের কাজ হচ্ছে সংঘাতের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করা।’ (বাংলাদেশের সিভিল সমাজ : সুশীল ও দুঃশীল? প্রতিচিন্তা, জানুয়ারি-মার্চ ২০১৭)

মিশেল ফুকোও মনে করেন, ‘সমাজ ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় না। সমাজের চালিকাশক্তি হলো সংঘাত। এই সংঘাত হচ্ছে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই।’ কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের বুদ্ধিজীবী এবং সিভিল সমাজের প্রতিনিধিরা নিজেরাই হয় সংঘাতে জড়িত, নয় তারা সঠিক কথাটি বলতে ভীতসন্ত্রস্ত। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর আমরা যে মহান বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, সেইসব শহীদ বুদ্ধিজীবী এতটা ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন না। ভীত হলে তাঁরা পালিয়ে বাঁচতে পারতেন। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ডিসেম্বর মাসে তাঁরা চাইলে ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহর থেকে পালিয়ে গ্রামে চলে যেতে পারতেন এবং পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের তালিকাভুক্ত হয়ে অকাতরে প্রাণ দিতে হত না। কিন্তু তাঁরা এতটা ভীত ছিলেন না।

এটা ঠিক, বুদ্ধিজীবী বা সিভিল সমাজের একার পক্ষে একটি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁরা সেই পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলবেন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতগুলো চিহ্নিত করে তার নির্মোহ বিশ্লেষণ দেবেন—এটিই কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষাও যেন এখন পূরণ হওয়ার নয়। এখন আমাদের বুদ্ধিজীবীগণ সজ্ঞানে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের হয়েই বলেন ও লেখেন। এখানে তাঁদের জাগতিক স্বার্থ ও প্রত্যাশা কতটুকু আর কতটুকুই বা ভীতি—তা নিয়ে বিশ্লেষণ হতে পারে। তবে সেই বিশ্লেষণ হোক বা না হোক, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা যে সূর্যসন্তানদের হারিয়েছি, যে আলোকবর্তিকাদের আমরা হারিয়েছি, তাঁদের বোধ ও চেতনা আমাদের আজকের বুদ্ধিজীবীদের স্নায়ুতে আঘাত করুক—এই প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক।