প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠি
সশ্রদ্ধ সালাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি। তিনি কৃষিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষাবিদসহ সব পেশাজীবীর সমন্বয়ে সমুন্নত বাংলাদেশ চেয়েছিলেন। তিনি তাদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কৃষিবিদরা ১৯৯৯ সালে কৃষিতে শীর্ষ পদক ‘সেরেস’এনে দিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। ২০০১ সালে ঘোষিত হলো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। সে ধারা বহমান। সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে ৪র্থ, ধানে ৪র্থ, প্রাণিসম্পদে জয়জয়কার, সুযোগ হয়েছে কোটি বেকার যুবকের আত্মকর্মসংস্থানের। পোশাকশিল্পে নেতৃত্বে বাংলাদেশ; ডিজিটাল বাংলা গড়ার প্রয়াস; তথ্যপ্রযুক্তি জনতার হাতের মুঠোয়; সড়ক মহাসড়ক ঘরের দরজায়; প্রকৌশলী যার রূপকার। শিক্ষা আজ ঘরে ঘরে, প্রতিভূ আমার সশ্রদ্ধ শিক্ষকগণ। স্বাস্থ্যসেবা হাতের নাগালে, পরিবেশ রক্ষায় কৃষি বিভাগ, বনবিভাগ, সড়ক ও জনপথ মুখ্য ভূমিকায়। উন্নত বাংলাদেশ গড়ায় স্বপ্নীল প্রধানমন্ত্রী আজ ‘চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ’ যার পেছনে কৃষিবিদ, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, গবেষকের উৎপাদনমুখী চিন্তা ও প্রয়াস। বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা ভাবতে হলে বাংলার চালিকা শক্তি এ উন্নয়নমুখী বুদ্ধিদীপ্ত পেশাজীবীদের মর্যাদার কথা ভাবতে হবে, তাদের অধিকারের কথা ভাবতে হবে, তাদের সহযোদ্ধা হিসেবে ভাবতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার নামে সরকারকে জনবিমুখ আমলাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করার প্রয়াস চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা মনে করি আপনি ও আপনার উন্নয়ন ধারা আজ আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের শিকার। কাজেই বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা উৎপাদনমুখী, বুদ্ধিদীপ্ত পেশাজীবী ও সরকারের ক্যাডার প্রতিনিধিরা চুপ থাকা আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের শামিল। আজ শিক্ষাবিদদের মর্যাদা পদানত করা জাতির মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেওয়ার শামিল, প্রকৌশলীর মর্যাদা পদানত করা মানে রাষ্ট্রের পুরো কৌশলকে প্রতিহত করা, চিকিৎসককে মর্যাদাহীন করা মানে পুরো স্বাস্থ্য সম্পদকে ধ্বংস করা, কৃষিবিদদের মর্যাদায় হস্তক্ষেপ করা মানে পুরো বাংলায় দুর্ভিক্ষকে হাতছানি দেওয়া।
কৃষিবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ বাংলাদেশ সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিতের কারিগর। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য এসব কারিগরের প্রতিনিধিত্বশীল ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের মুখপাত্র/ দপ্তর / অধিদপ্তর/ প্রতিষ্ঠানের প্রধান যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সার্বিক ধারণা রাখে, জ্ঞান রাখে তাদের কথা, মাঠের প্রকৃত চিত্র প্রধানমন্ত্রী বরাবর কোনো দিন পৌঁছে না। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে সহজে তারা পৌঁছাতে পারে না।
আমরা মনে করি রাষ্ট্রের উন্নয়নমুখী খাতগুলোকে অপেশাজীবী শক্তি পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের কথা ভাবে তারা রাষ্ট্রের শত্রু, উন্নয়নের শত্রু, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের শত্রু। দেশের ১০ লাখ কর্মকর্তা কর্মচারী ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। শধু তারা ব্যতীত যারা জনগণের সেবকের পরিবর্তে জনপ্রশাসনের নামে জনগণকে শাসন করতে চায়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, মাঠ প্রশাসন সংযোগ অধিশাখা এর নম্বর -০৪.০০.০০০০.৫১২.৮২.০৪৮.১৪-৪০২; তারিখ ১৪ অক্টোবর’ ২০১৫ অফিস স্মারকে উক্ত বিষয় সংক্রান্ত পত্র জারি হয়। উক্ত পত্র এর অনুচ্ছেদ ৬, ৭ মোতাবেক উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং আনুষঙ্গিক ব্যয়ের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/ বিভাগের রাজস্ব বাজেট থেকে প্রদত্ত অর্থ ও মন্ত্রণালয়/ বিভাগের উন্নয়ন বাজেট থেকে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য থোক বরাদ্দ বাবদ উপজেলা পরিষদকে প্রদত্ত অর্থ, পিএল (Personal Ledger Account) অ্যাকাউন্টে রক্ষিত হবে এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের যৌথ স্বাক্ষরে এ হিসাব পরিচালিত হবে। উক্ত পত্র এর অনুচ্ছেদ ৮ ও ৯ মোতাবেক কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর বিভাজনযোগ্য অংশের অনুদান বাবদ উপজেলা পরিষদকে প্রদত্ত অর্থ ও আনুষঙ্গিক কার্যাবলির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পিএল অ্যাকাউন্টে রক্ষিত হবে এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ও উপজেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রধানদের যৌথ স্বাক্ষরে এ হিসাব পরিচালিত হবে।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উপজেলা পরিষদ ক্ষমতায়ন বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ পদক্ষেপের অংশ হিসেবে জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে সব বিভাগ/ দপ্তরের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার বিষয়টি আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাকে সুকৌশলে করায়ত্ত করার পরিকল্পনায় মেতেছে প্রশাসন ক্যাডার।
পেশাজীবীদের দপ্তরের মাধ্যমে, মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নির্দেশনায় ও নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকারের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যানের পাশাপাশি উপজেলায় হস্তান্তরিত একটি দপ্তরের কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী অফিসার অন্য ১৬টি হস্তান্তরিত দপ্তরের তদারকি ও আর্থিক বিষয় পরিচালনা করলে—
১. তা সরকারের প্রগতিশীল কর্মপ্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং প্রশাসন যন্ত্র অচল হয়ে পড়বে।
২. উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত দপ্তর প্রধানরা অফিসের সত্তা হারাবেন এবং তাঁর কার্যালয়ের অন্যান্য গেজেটেড কর্মকর্তার আর্থিক ক্ষমতা রহিত হবে। গেজেটেড কর্মকর্তাদের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা হিসেবে প্রদত্ত ক্ষমতা খর্ব হবে।
৩. অধিদপ্তর প্রধান ও অফিস প্রধানরা জনবল ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ হারাবেন এবং কার্য সম্পাদনে শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে।
৪. সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
৫.উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তদারকিতে তুলনামূলকভাবে জ্যেষ্ঠ ক্যাডার কর্মকর্তাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা অস্বস্তিকর, বিড়ম্বনামূলক, অপমানজনক ও বিধি পরিপন্থী।
৬. এক দপ্তরের ক্যাডার অফিসার অন্য দপ্তরের একই গ্রেড বা অপেক্ষাকৃত উন্নত গ্রেডের একজন ক্যাডার অফিসারের বেতন ও আনুষঙ্গিক ব্যয়ে হস্তক্ষেপ অযৌক্তিক, অমর্যাদাকর এবং অগ্রহণযোগ্য।
৭.উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কাজ বাস্তবায়নে মধ্যস্বত্বভোগী দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য বাড়বে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং জনগণের দোরগোড়ায় দ্রুত সেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে।
৮. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ তো হবে না বরং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর কর্তৃক উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন দপ্তরে অর্পিত দায়িত্ব ও ক্ষমতা আরো কেন্দ্রীভূত হবে।
৯.কারিগরি ক্যাডার কর্মকর্তাদের ওপর অকারিগরি কর্মকর্তাদের খবরদারি বাড়বে যা প্রযুক্তিবান্ধব সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
বিষয়টি সরকারের অনুধাবন যোগ্য। আমরা জনগণের সেবক, আমরা জনগণের বন্ধু, জনগণের আজ্ঞাবহ। আমরা চাই না রাষ্ট্রে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। সরকারি কার্য সম্পাদনে সর্বোচ্চ সমন্বয়, স্বচ্ছতা, গতিশীলতার মাধ্যমে জনকল্যাণমুখী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে উপরোক্ত অফিস স্মারক প্রত্যাহার করে নিজ নিজ দপ্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে আবেদন জানাচ্ছি।
প্রগতিশীল, যুগোপযোগী, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নিম্নোক্ত দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য মিনতি জানাই।
১. মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ক্যাডার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
২. উপজেলায় হস্তান্তরিত সব দপ্তরের বেতনসহ অন্য অর্থসংক্রান্ত বিলে ইউএনওর সিদ্ধান্ত বাতিলকরণ।
৩. ৮ম পে স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল পুনর্বহাল।
৪. সব ক্যাডারে ইনসিটো পদোন্নতির ব্যবস্থাকরণ।
৫. সকল ক্যাডারের সমন্বয়ে ক্যাডার সমতা বোর্ড প্রতিষ্ঠাকরণ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমাদের আকুতি, আপনি এ বিষয়গুলো সদয় নজরে আনবেন এবং এর আশু প্রতিকারের ব্যবস্থা নেবেন।
পত্রপ্রেরক : কৃষিবিদ, অতিরিক্ত কৃষি অফিসার