বিশ্বকাপ ক্রিকেট

প্লিজ, বাংলাদেশকে গোনায় ধরবেন না

Looks like you've blocked notifications!

বিশ্বকাপ শুরুর আগে বাংলাদেশের মানুষ ছাড়া বাংলাদেশকে কেউ গোনায় ধরেনি। ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উথাল-পাথাল আবেগ। সেই আবেগের কাছে বারবার হার মানে যুক্তি। তবে একেবারে যুক্তিহীন তা বলা যাবে না।

আগেও তো বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলেছে, আবেগ তো তখনো ছিল। কিন্তু কই, আগে তো কখনো বাংলাদেশের স্বপ্ন এমন আকাশ ছোঁয়নি। এবার মিনিমাম প্রত্যাশা সেমিফাইনাল। আর সেমিফাইনালে গেলে কেন ফাইনাল নয়, কেন শিরোপা নয়? এমন প্রশ্নও ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। কেন নয়? শুধু আবেগ দিয়ে এই প্রশ্নের জবাব মিলবে না।

রোববার বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ সেই প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছে। মাঠের পারফরম্যান্সে এখন পর্যন্ত এবারের বিশ্বকাপের সেরা দল বাংলাদেশে। সর্বোচ্চ ইনিংস, দক্ষিণ আফ্রিকাকে দারুণ স্টাইলে হারিয়ে বাংলাদেশ এখন অনেকের পাকা ধানে মই দিয়েছে, বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে, অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে, অনেকের হিসাব-নিকাশ উল্টে গেছে।

রোববার সকালে আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম, ‘শুরুর আগে শুনলাম এবারের বিশ্বকাপে রানের বন্যা বয়ে যাবে। ম্যাচে ম্যাচে ৩০০ হবে। ৪০০, এমনকি ৫০০ রানও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কোথায় সেই বন্যা? বিশ্বকাপে দেখি রান বন্যায় ধস নেমেছে। ২০০ পেরোতেই জান বেরিয়ে যাচ্ছে সবার। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা তো এশিয়ার মান ডুবিয়েছে। আফগানিস্তান কোনো রকমে ২০০ পেরিয়েছে। প্রথম তিন দিনে একটাও ভালো ম্যাচ হয়নি। আমার ধারণা, আজ বাংলাদেশে বিশ্বকাপকে জমিয়ে দেবে। বাংলাদেশের জয় দেখার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। শুভকামনা টাইগার্স। আই লাভ ইউ।’

জয়-পরাজয়ের চেয়ে বড় কথা বাংলাদেশ বিশ্বকাপের মান বাঁচিয়েছে। প্রথম তিন দিনে একতরফা ম্যাড়ম্যাড়ে ম্যাচের পর বাংলাদেশ একটা বিশ্বকাপ মানের ম্যাচ উপহার দিল। বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। তবে বিশ্বাস করুন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে আমার একবারও মনে হয়নি বাংলাদেশ হারবে। সৌম্য সরকারের ফ্লাইং স্টার্টের পর সেই যে উড়ে চলা, ৩৩০ রান হওয়ার পর আর মনে হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকা পারবে। এমন ম্যাচকে তো একতরফাই বলে। তবু দলটা দক্ষিণ আফ্রিকা বলে কারো কারো ভয় ছিল, আমার ছিল না। এই সুখের দিনে একটা সতর্কতার কথা বলি, বড় কিছু করতে হলে ফিল্ডিং আরো টাইট হতে হবে। ফিল্ডিংয়ে নামার সময় হাতে মাখন নয়, চুম্বক লাগাতে হবে।

শুরুতেই গোনায় ধরার কথা বলছিলাম। সবাই ফেভারিট হিসেবে ইংল্যান্ড, ভারত, অস্ট্রেলিয়ার নাম এক নিঃশ্বাসে বলেন। তারপর একটু দম নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, এমনকি ওয়েস্ট ইন্ডিজের নামও বলেছেন। কিন্তু কোথাও বাংলাদেশের নাম নেই।

তবে আমার বিবেচনায় টপ ফেভারিট ভারত। কারণ তাদের মাঠের পারফরম্যান্সও ভালো, টেবিলের পারফরম্যান্সও ভালো। এবার যে এখনো তাদের মাঠে নামতে হয়নি, সেটাই টেবিলের পারফরম্যান্স। বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে ৩০ মে। প্রথম তিন দিনে আট দল মাঠে নেমেছে। বাকি ছিল শুধু বাংলাদেশ আর ভারত। হিসাবে রোববার চতুর্থ দিনে বাংলাদেশ আর ভারতের মাঠে নামার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা খেলছে তাদের দ্বিতীয় ম্যাচ। ভারতের দেখা নেই।

ভারতের প্রথম ম্যাচ ৫ জুন, টুর্নামেন্টের সপ্তম দিনে। তাদের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা খেলবে তৃতীয় ম্যাচ। কেন? ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নাকি আইসিসির কাছে আবদার করেছিল, আইপিএলের সঙ্গে যেন তাদের বিশ্বকাপ ম্যাচের সর্বোচ্চ গ্যাপ রাখা হয়। আইসিসি সে আবদার রেখেছে। অনেক দিন ধরেই ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলে পরিণত হওয়া আইসিসি যার পাশে আছে, সেই ভারত অবশ্যই টপ ফেভারিট। বাংলাদেশ একাধিকবার আইসিসির এই ভারতপ্রীতির বলি হয়েছে।

বলছিলাম ফেভারিটের তালিকার কথা। আমরা না হয় আবেগী, বুঝি না। কিন্তু বিশেষজ্ঞরাও কি বোঝেন না? ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স গ্রাফ কি তাদের চোখে পড়ে না। দুদিন আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুঁড়িয়ে দেওয়া পারফরম্যান্স কি তাদের চোখে পড়েনি? তারা কি ক্রিকেট বোঝেন না, নাকি বাংলাদেশকে ঈর্ষা করেন? নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ক্রিকেট জ্ঞানের প্রতি আমার আস্থা ছিল। তিনি অনেক হিসাব-নিকাশ করে দেখিয়েছিলেন, বাংলাদেশ মাত্র একটা ম্যাচ জিতবে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। এবারের বিশ্বকাপের যে ফরম্যাট, তাতে সব দলকেই অন্তত ৯টা ম্যাচ খেলতে হবে। ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকবে সবারই। লম্বা টুর্নামেন্টে সবারই পারফরম্যান্স ওঠানামা করবে। তাই বলে বাংলাদেশ মাত্র একটা ম্যাচ জিতবে, এটা ম্যাককালাম ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না। প্রথম দিনেই ম্যাককালামের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ, সৌম্য, মুস্তাফিজ, সাইফুদ্দিনরা।

বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবেই, এমন দাবি আমি করছি না; তবে এই বাংলাদেশ কিন্তু ’৮৩-এর ভারত, ’৯২-এর পাকিস্তান এবং ’৯৬-এর শ্রীলঙ্কার চেয়ে ভালো। অভিজ্ঞ পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে দুরন্ত তারুণ্য দারুণ ভারসাম্যপূর্ণ এক দলে পরিণত করেছে। আমি বলে দিচ্ছি, এই দল আপনাদের আরো অনেক হিসাব-নিকাশ ওলটপালট করে দেবে, আরো অনেক রাত আপনাদের নির্ঘুম থাকতে হবে। ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতে যে গতি নিয়ে বিশ্বকাপে এসেছিল বাংলাদেশ, প্রথম ম্যাচেই তা দারুণ মোমেন্টাম পেয়েছে। এখন শুধু গতিজড়তায় এগিয়ে যাওয়া।

তবে আন্তর্জাতিকমানের সম্মানিত ক্রিকেট বোদ্ধারা, প্লিজ এখন নিজেদের মান বাঁচাতে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশের নাম ফেভারিট তালিকায় তুলে দেবেন না। গোনায় ধরে বাংলাদেশকে চাপে ফেলবেন না। বাংলাদেশের চাপ ছাড়া, মনের আনন্দে খেলুক। বিশ্ববাসী মনের আনন্দে সুকান্তর কবিতা আবৃত্তি করুক :

‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী

অবাক তাকিয়ে রয়

জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার

তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

প্রিয় ক্রিকেটাররা, তোমাদের কাছে আমার ভালো খেলা ছাড়া আর কোনো প্রত্যাশা নেই। তোমরা কোনো চাপ নিও না। আর তোমরা তো জানোই, আমাদের হারানোর কিছু নেই, জয় করার জন্য আছে গোটা বিশ্ব।

প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও কলাম লেখক