স্মরণ

আনন্দে কাটুক আপনাদের ঈদ, আমার বিষাদে

Looks like you've blocked notifications!

আজ ঈদ। আমিও তৈরি ছিলাম আনন্দের জন্য। এবারের আনন্দ হতে পারতো আমার জন্য আরো অন্যরকম, আরো বেশি। কারণ পুত্রের বেতনের টাকায় বানানো পাঞ্জাবি পড়ে আমি নামাজে যেতাম। একজন পিতার এর চেয়ে বেশি চাওয়া হয়তো নেই, থাকেও না। একজন সন্তান পড়াশোনা শেষ করে, যোগ্য হয়, চাকুরি করে, তারপর পিতাদের সুদিন আসে ছেলের কেনা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঈদের জামাতে খোদার মুখোমুখি দাঁড়াবার, কৃতজ্ঞতা জানাবার। সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, আমার ছেলে, সে সুযোগটি আমাকে করে দিয়েছে। তারপর সে চলে গেছে না ফেরার দেশে।

আমার ছেলে পড়াশোনার সাথে সাথে সময়ের অনেক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিলো, যোগ্য হয়ে উঠেছিলো। দাদা, বাবা এবং তারও আগের বংশ পরম্পরাকে ধরে রাখতে যোগ দিয়েছিলো গণমাধ্যমে। নিউজ পোর্টাল প্রিয় ডটকমের ইংরেজি বিভাগের সহ-সম্পাদক হিসাবে কাজ করছিলো ফাগুন। ক্রমেই সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রয়োজনীয় করে তুলছিলো গণমাধ্যমে। অন্তত ফাগুন যাদের সাথে কাজ করতো তারা তাই বলতেন এবং বলছেন।

শুধু সম্পাদনাই নয়, রিপোর্টিংয়েও খুব ভালো ছিলো ফাগুন। তার অফিসের সিনিয়র রিপোর্টাররাও তাই বলেছেন। সাগ্রহে করতো এ কাজটি সে। তার মাধ্যম ইংরেজি হলেও, বাংলাতেও তার হাত ছিলো চমৎকার। বাংলায় করা ফাগুনের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে কথা রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম গণমাধ্যম ডয়চেভেলে তাদের খবরের শিরোনাম করেছিলো, ‘খবর প্রকাশের কারণেই কি খুন হলেন ফাগুন?’- এমনটা। কথাটা অনেকেই বলেছেন, বলছেন। তবে কি অসম্ভব মেধাবী ফাগুন জেনে ফেলেছিল এমন কোন তথ্য, যা বিশেষ কারো বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারতো। জানি না, আসলে কি ঘটেছিলো। কেন এভাবে অকালে যেতে হলো ফাগুনকে।

গত ২১ মে ঢাকা থেকে ট্রেনে নিজ বাড়ি শেরপুরে ফিরছিলো ফাগুন। রাত সাড়ে সাতটার পর ওর সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় আমার। পরদিন বিকালে তাকে পাই মৃত। যখন জামালপুর গোরস্থানে বেওয়ারিশ হিসাবে চলছিল তার তড়িঘড়ি দাফনের চেষ্টা। কিন্তু পিবিআইয়ের কারণে সে চেষ্টা সফল হয়নি। যদি হতো, তাহলে হয়তো আজ পর্যন্ত নিখোঁজের তালিকায় যুক্ত হতো ফাগুনের নাম। আর আমরা থাকতাম প্রতিদিনের প্রতীক্ষায়। দরোজায় বাতাসের শব্দেও বলতাম, ‘এলিরে বাবা’।

ঘটনার দু’সপ্তাহ হতে চললো, ফাগুন হত্যাকান্ডের কোনো ক্লুই এখনো খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ বলছে, তারা চেষ্টা করছে। তাদের চেষ্টায় আমি বিশ্বাস রাখতে চাই। বিশ্বাস করতে চাই, পুলিশ পারে না এমন কিছু নেই। একজন তরুণ সাংবাদিকের খুনিদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে পারবে পুলিশ। তবে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। যত দেরি হবে, ততই কঠিন হয়ে পড়বে রহস্য উদঘাটন। যেমন, বিলম্বিত বিচার অবিচারেরই নামান্তর। কথা রয়েছে, ‘জাস্টিজ ডিলেইড, জাস্টিজ ডিনাইড’। সুতরাং পুলিশকে আরেকটু তৎপর হতে হবে। শুধু আমার ছেলে বা একজন সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন নয়, পুলিশ সদস্যদের নিজেদেরও সন্তান রয়েছে। তাদের মুখের দিকে চেয়ে হলেও এটা তাদের করতে হবে, করা উচিত।

ফাগুনের সহকর্মীদের দেখেছি ফাগুনের জন্য তৎপর হতে। তারা যতটুকু যেখানে পেরেছে করেছে, করছে। দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকদের অনেকেই আমাকে ফোন করেছেন, শোক জানিয়েছেন, তারাও করছেন তাদের সাধ্যমত। লিখছেন, খবর করছেন। এতটা সত্বেও অনেকেই আছেন যারা ব্যাপারটিতে গা-মাথা নাড়াননি। একজন তরুণ সাংবাদিক, যার বাবাও রয়েছেন গণমাধ্যমে, তাও তাদের চিন্তায় বিষয়টি নাড়া দেয়নি। কেন দেয়নি, তারাই জানেন। সাংবাদিক নেতাদের কেউ-ও রয়েছেন এরমধ্যে। যাদের নেতা হিসাবে দায়িত্বটা অন্যদের চেয়ে বেশি।

যাক গে, তাদের গা-মাথা নড়েনি, তাতে আমার ক্ষোভ নেই। যেমন সাগর-রুনির মেঘের এখন কোন ক্ষোভ নেই। সে বাবা-মা হারা, আর আমি সন্তান হারানো পিতা। আমাদের ঈদ কষ্টের হোক, বিষাদের হোক। আপনারা ভালো থাকুন, সবাই ভালো থাকুক। আপনাদের ঈদ কাটুক নিজ সন্তানকে বুকে করে। ঈদের জামায়াত শেষে বুক মেলান প্রিয় সন্তানের সাথে। আদরে চুমু খান তাদের কপালে। আর আমি তখন ছেলের কবরে মেশাবো অশ্রু-জল। সৃষ্টিকর্তা আজীবনের জন্য আমার অশ্রুনালী খুলে দিয়েছেন, যা আর বন্ধ হবার জো নেই। তবু এই অশ্রু ভেজা চোখেই আমার সন্তানের সাথে আপনাদের সন্তানদের জন্যও দোয়া করবো, তারা যেন ভালো থাকে। থাকে যেন আপনাদের বুকেই। কারণ আমি জানি, সন্তান হারানোর ব্যথা সইবার সাধ্য কোন বাবার ক্ষুদ্র বুকের নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।