ভারতে প্রতিবাদী কণ্ঠগুলো কী বলছে?

Looks like you've blocked notifications!
আলী রীয়াজ

ভারতের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী পি এম ভার্গব পদ্মভূষণ ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দেশে ক্ষমতাসীন বিজেপির সমর্থন এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলোর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সারা দেশে যে অসহিষ্ণুতা বিস্তার লাভ করেছে এবং হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে তার প্রতিবাদে ভার্গব তাঁর পদক ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। বিজ্ঞানী ভার্গবকে ১৯৮৬ সালে মর্যাদাপূর্ণ পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয়। সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন ভার্গব। তিনি বলেছেন, ‘আমি সৎ মানুষ। আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই। আমি সম্মান ফিরিয়ে দেব।’ বুধবার ১০৭ জন বিজ্ঞানী অনলাইনে স্বাক্ষর করে ক্ষমতাসীনদের আচরণের প্রতিবাদ জানান। তার আগের দিন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে দেশের ১৩৫ জন বিজ্ঞানী অনলাইনে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছেন। বুধবার দেশের বিখ্যাত ১০ চলচ্চিত্র নির্মাতা জাতীয় পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত দায়বদ্ধতা পালন করতে হবে। আমরা সেই সব সাহিত্যিকদের পাশে দাঁড়াতে চাই, যাঁরা দেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছেন।’

স্মরণ করা যেতে পারে যে কয়েক সপ্তাহ ধরে লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাঁদের পদক ও পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিল্পী-সাহিত্যিকরা বিক্ষোভ করছেন। দেশের ৫৩ জন ইতিহাসবিদ দেশের ক্রমবর্ধমান হানাহানি নিয়ে তাঁদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। ইতিহাসবিদদের সংগঠন ‘সহমত’–এর পক্ষে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বিরুদ্ধ মতকে হিংসা দিয়ে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যুক্তির প্রতিযুক্তি না দিয়ে উত্তর দেওয়া হচ্ছে বুলেটে। যখন একের পর এক সাহিত্যিক তাঁদের পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করা হচ্ছে না। কী কারণে তাঁদের এহেন আচরণ তার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে না। উল্টে মন্ত্রীরা বলছেন এটা কাগুজে বিপ্লব। লেখা বন্ধ করার উপদেশও ভেসে আসছে।’

তাঁদের ভাষায়, ‘দেশের পরিস্থিতি কলুষিত।‘ বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব, কে এন পান্নিকার ও মৃদুলা মুখার্জি। দেশের ৩০০ জন শিল্পী, যাঁদের মধ্যে আছেন সুধীর পত্রধান, নীলিমা শেখ, অঞ্জলি এলা, বিবন সুন্দরমের মতো বিখ্যাতরা, সম্প্রতি এক বিবৃতিতে অন্যদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন। তাঁদের এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সৃষ্টিশীল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ নিয়ে এই ক্ষমতাসীন সরকারের মতাদর্শ অবজ্ঞামূলক; যেখান থেকে কেবল সেন্সরশিপ আর ধর্মান্ধতার উৎপাদন হয়। অতীতের ধারাবাহিকতায় আমরা লড়াই চালিয়ে যাব, প্রতিবাদ করব, সরব থাকব। আমরা আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের সামগ্রিক পাটাতনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্ম ও সংস্কৃতি ভেদে মানুষে মানুষে ভিন্নমত আর পার্থক্য নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য লড়াই করে যাব। আমরা এমন একটা সরকারের অধীনে রয়েছি, যারা বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। যারা প্রান্তিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জীবন ও স্বার্থকে সুরক্ষা দিতে অস্বীকার করে। আমরা মনে করি, একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিসরে এই সরকার তার বৈধতা হারিয়েছে।’

গোমাংস–গুজবে দাদরিতে মুহাম্মদ আখলাখকে হত্যা, মুক্তমনা এম এম কালবুর্গি হত্যার ঘটনা সর্বসাম্প্রতিক প্রতিবাদের আশু কারণ হলেও কয়েক বছর ধরেই ভারতে ধর্মভিত্তিক অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এর অন্যতম কারণ বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি; কিন্তু সেটা একমাত্র কারণ নয়, কংগ্রেস এবং অন্যান্য দলের পরোক্ষ সমর্থন বা অবস্থাকে মেনে নেওয়াও কারণ। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার নির্বাচনের আগে ও অব্যবহিত পরে আরএসএস এবং ভিএইচপির মতো উগ্রপন্থীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির ইঙ্গিত দিলেও গত এক বছরে এটা স্পষ্ট যে, মোদি এবং বিজেপি এখন ‘সংঘ পরিবারের’ এজেন্ডার বাইরে যাবে না। এ বছরের ৪ সেপ্টেম্বর সংঘ পরিবারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদি, বিজেপির নেতা এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের বৈঠক সম্ভবত সবচেয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। ক্ষমতায় আসার মাত্র ১৬ মাসের মধ্যেই এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং তা আলাদা করে ডাকা হয়েছিল। বাজপেয়ি সরকারের সঙ্গে সংঘ পরিবারের বৈঠক হয়েছিল ২০০৩ সালে, যখন বাজপেয়ি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ যাবৎ কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া নিয়োগের একটা বড় অংশই গেছে আরএসএসের লোকজনের হাতে। রাম নায়েক, ওপি কোহলি, বলরামজি দাস ট্যান্ডন, কেশরি নাথ ত্রিপাঠী, কল্যাণ সিং, মৃদুলা সিনহা যে কট্টর সংঘ পরিবারের লোক সে বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই।

ভারতের শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-ইতিহাসবিদরা যে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন, সেটাকে কোনো অবস্থাতেই ছোট করে দেখার নেই। একে কেবল বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মনে করলে এর গুরুত্বকে খাটো করা হবে, কেবলমাত্র ধর্মাশ্রয়ী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ভাবলেও এর তাৎপর্য বোঝা যাবে না। এই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরগুলো কী বলেছেন সেটা ভালো করে শোনা দরকার। তাঁরা কী বলছেন? বিবৃতিগুলোর কিছু অংশ আমি উদ্ধৃত করেছি, সেগুলোতে ভালো করে নজর দিলেই দেখতে পাবেন যে এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্ন আছে, ভিন্নমত নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা আছে, প্রান্তিক মানুষের জীবন ও স্বার্থের সুরক্ষার কথা আছে, আছে সাংবিধানিক অধিকারের পাটাতনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্ন। তা ছাড়া বিজ্ঞানী ভার্গবের কথাটা আমাদের আবার মনে করা দরকার, ‘আমি সৎ মানুষ। আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই। আমি সম্মান ফিরিয়ে দেব।’

আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক