একজন শাহাদাত একটা বাংলাদেশ

Looks like you've blocked notifications!
ফারহানা লাকী

রং চটে যাওয়া দুই ফিতাওয়ালা এক জোড়া স্যান্ডেল। তাও আবার কালো ফিতার লাল স্যান্ডেল। রুচি কেমনরে বাবা! মনে মনে বলে মুখের দিকে তাকালাম। ঢোলা জিন্সের প্যান্টের ওপর কাঁধের কাছে সেলাই খুলে যাওয়া গেঞ্জি গায়ে বসে আছে সে। চেহারাও অপরিচ্ছন্ন। সম্ভবত আজ গোসলও করেনি। আমার একটু অস্বস্তি হলো। এই ছেলে আমার পাশের সিটে বসে আছে। একটু বিরক্ত ভাব নিয়ে নিজের সিট নম্বর মেলাই। এই অপরিচ্ছন্ন নোংরা কিশোরের পাশেই দিল আমার সিট! আমার নাক উঁচু আহামরি ভাব দেখে ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসার চেষ্টা করল সে। আমি যেন একটু পেয়ে বসলাম তাকে। নাক উঁচু ভাবটাকে একটু চড়িয়ে নিয়ে বেশ বিরক্ত কণ্ঠেই বললাম, ঠিক আছে ঠিক আছে বসেন আপনি।

বিমানে ছেলেটি আমার সহযাত্রী। মালয়েশিয়া থেকে ঢাকা। উড্ডয়নের সময় সিটবেল্ট বাঁধার অনুরোধ করা হচ্ছে। এই ছেলে সিট বেল্ট বাঁধতে হয় কীভাবে জানে না। চেষ্টা করেই যাচ্ছে। বললাম, দাও আমার কাছে। হাত বাড়িয়ে সিটবেল্ট বেঁধে দিলাম। শুকনা পটকা শরীর। বললাম, খাও না? এত শুকনো কেন তুমি? শরীর ঠিক আছে তো? প্রশ্রয়ের হাসি হাসল। ‘খাই আপু। দিনে একবেলা ভাত খাই।’ কেন একবেলা খাও কেন? তিন বেলা খেতে নিষেধ নাকি? ‘পয়সা নাই তো আপু।’ ধক করে বুকে বাঁধল এই ছেলের কথা। বলে কি! পয়সা নেই। দিনে একবার ভাত খায় এই কৈশোর পেরোনো ছেলে।

জানতে চাইলাম ওর কথা। নাম শাহাদাত। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তিন বছর আগে মালয়েশিয়া যায়। থাকে গ্যানতিনে। একটা চীনা গোরস্তানে (চায়নিজ গ্রেভিয়ারড) কাজ করে। দিনে বেতন পায় ৫০ রিঙ্গিত, যা বাংলাদেশি টাকায় ৯৫০ টাকা। নিজে খেয়ে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা মাকে পাঠায়। দুপুরে একবেলা ভাত খায়। রাতে কখনো খায় কখনো খায় না। এত কষ্ট করে যে নিজের জন্য একটা জামা কেনে না। জুতা কেনে না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাড়িতে শাহাদাতের মা, বাবা ও পাঁচ ভাইবোন থাকে। বাবা অসুস্থ। ভাইবোন ছোট ছোট। ও একাই রোজগার করে। চার শতক জমি বিক্রি করে মালয়েশিয়া গিয়েছে। সেই জমি সে আবার কিনেছে। সঙ্গে আরো ১১ শতক জমি কিনেছে। কথার ঝুড়ি খুলে বসে এবার শাহাদাত। আমার বিরক্ত ভাব চলে যায়।

শাহাদাত তিন বছর পর দেশে ফিরছে। কত স্বপ্ন, কত ভালো লাগা সঙ্গে নিয়ে দেশে আসছে। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনি। ওকে চকলেট খেতে দেই। ওর গল্প শুনে ওর প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়ি। আমি চুপ করে যাই। ভাবি ওর কথা। ওর কষ্টের কথা। স্বপ্নের কথা। একরত্তি বুকের ভেতর বসে থাকা হাজার স্বপ্নের কথা। আমার ইচ্ছে করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করতে।

বলতে ইচ্ছে করে শাহাদাত, তুমি তোমার স্বপ্নের চেয়েও বড়। বলা হয় না। মুগ্ধতা নিয়ে চুপ মেরে বসে থাকি। শাহাদাত কথা বলে যায় অনর্গল।

রাত সাড়ে ১২টা। শাহাদাতের চোখে ঘুম নেই। কথা বলে চলছে। বিরতি নেই ওর। আমাকে বলে চলছে ওর কষ্টের কথা। বিমানের প্রায় সবাই ঘুমে ঘুমে আচ্ছন্ন। আমারও একটু চোখ লেগে এসেছে। হঠাৎই খেয়াল করলাম উসখুস করছে শাহাদাত। ঘুম ঘুম ভাবের আমাকে, আমার বাচ্চাদেরকে ডিঙিয়ে আমার মাথার ওপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করছে। একবার, দুবার না বারবার। বললাম কী হয়ছে? ঘুমাও। বলল আপু আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে? কেন? হাসে। লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে বসে থাকে। আমার মায়া লাগে। আবার গপ্প করি। ওর কষ্টের কথা শুনি। স্বপ্নের কথা শুনি। ও কথা বলে আর উসখুস করে। বলি মা কে দেখার জন্য মন অস্থির? আবারও লজ্জা পায়।

ঘণ্টাখানেক পর বললাম এই তো কাছাকাছি চলে আসছি। চকিতেই উঠে দাঁড়াল শাহাদাত। আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জানালায় চোখ রেখে আচমকাই চিৎকার দেয় শাহাদাত। ‘আপু ওই যে বাংলাদেশ দেখা যায়।’ ওই যে বাংলাদেশ আপু। আমার হাত ধরে টেনে উঠিয়ে নিয়ে বলে, ‘আপু দেখেন দেখেন বাংলাদেশ। আমি উঠে দাঁড়াই। শাহাদাতের মতো জানালায় ঝুঁকে দেখি বাংলাদেশকে। রাতের বাংলাদেশ আরো সুন্দর। অনেক সুন্দর। শাহাদাতের চোখে বাংলাদেশ দেখি। আমি অবাক হয়ে শাহাদাতকে দেখি। আমার মনে হয় ও নিজেই একটা বাংলাদেশ। অপূর্ব সুন্দর এক মানুষ। একটা দেশ। একটা কিশোর এর বুকে বসে থাকা বাংলাদেশকে দেখি।  আমি ওর কাঁধে হাত রাখি। ও আবেগে কেঁদে ফেলে। টের পাই আমার চোখেও পানি। ওই তো আমার, আমাদের বাংলাদেশ। আমি আর কথা বলতে পারি না। বাকরুদ্ধ হয়ে থাকি। কান্নায় ডুকরে উঠি একটা শাহাদাত, একটা বাংলাদেশ। কে কবে কার দেশকে এতটা ভালোবেসেছে। আমরা যতটা ভালোবাসি। ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা...