অভিজিৎরা কি এভাবেই মারা যাবেন?

Looks like you've blocked notifications!
ফিরোজ আহমেদ

আজ থেকে ১১ বছর আগে বইমেলা ফেরত হুমায়ূন আজাদের ওপর যখন হামলার খবর পেয়েছিলাম, বিশ্বাস করতে পারিনি। বইমেলায়, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এমন ঘটনা ঘটবে, এটা তখন কল্পনার বাইরে ছিল।
অভিজিৎ রায় এর ওপর হামলার খবর শোনা মাত্র অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসেনি, আশঙ্কাটাই বরং নিমেষে তীব্রভাবে গ্রাস করেছে। তখন এটা অবিশ্বাস্য ছিল, এখন এটাকে বাস্তব, সম্ভব বলে মেনে নিয়েছি, এই তো অগ্রগতি।

মাত্র দুই দিন আগে তার সাথে পরিচিত হলাম বইমেলায়, বিজ্ঞানের বইপত্র নিয়ে অনেক আড্ডা হলো। স্মৃতিটুকু এখনো উষ্ণ রয়ে গেছে। মর্মান্তিক এই অনুভূতি ছাপিয়ে কিছু লেখা বা বলা কঠিন। একটা ছবি দেখলাম, রক্তাক্ত বন্যা সাহায্যের জন্য ডাকছেন, আর পেছনে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা অভিজিতের লাশ। এই দৃশ্য কোনোদিন যেন ভুলতে না পারি, এই দৃশ্য কাউকে ভুলতে না দেওয়া হোক। এই দৃশ্যের প্রায়শ্চিত্ত না করে আমরা কেউ মুক্ত হতে পারব না, আমাদের জাতি মুক্ত হতে পারবে না।

২.

অসহিষ্ণুতা এই রাষ্ট্র আর সমাজের স্তরে স্তরে টিকিয়ে রাখা হয়েছে, তাকে লালন করা হয়েছে, প্রয়োজন মতো প্রকাশ্য লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে, কখনো কখনো গোপন আততায়ী হিসেবে তারা শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করার বিষয়টা খেয়াল করুন, বেশিরভাগ জাতীয় পত্রিকায় এটা কোনো সংবাদ হয়নি। এর প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশটাও খবর হয়নি। বইমেলাতে আস্ত একটা প্রকাশনীর দোকান বন্ধ করে দেওয়া হলো, বাংলা একাডেমির কর্তাব্যক্তিরা সাক্ষাৎকার দিয়ে বললেন, আলোচ্য বইটা তিনি পড়েননি, অভিযোগ শুনেছেন! এটা কিভাবে খবর না হয়ে পারল? অথচ মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ইত্যাদি তো এখানকার গণমাধ্যমের পছন্দের সংবাদ। রোদেলা এই কারণে খবর হয়নি, কারণ এটা সংবাদ হলে যারা বিব্রত হবেন, তাদের বিব্রত করতে চায়নি গণমাধ্যম। হাজার হলেও তো বাংলাএকাডেমি ‘বাঙালির মননের প্রতীক’, বইমেলা মিষ্টি মিষ্টি সব সংবাদের ভাণ্ডার। সেখানে অপ্রীতিকর কোনো সংবাদকে গুরুত্ব দিতে কিংবা মৌলবাদীদের চক্ষুশূল হতে রাজি না প্রায় কেউ।

এইভাবে কতবড় একটা মাফিয়া চক্র মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে তার ক্ষমতা বাড়িয়ে নিচ্ছে, কিন্তু বাকিরা দেখেও না দেখার ভান করল, যেন কিছু ঘটেনি। প্রকাশকদের এরা বুঝিয়ে দিল, কোনো বই প্রকাশ করা যাবে না, লেখকদের জানিয়ে দিল কোনো লেখায় সে আর নিরাপদ থাকবে না। এই মাপের মাঝে থেকে এই ছকে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে তুমি সংস্কৃতিবান হও, গ্রন্থকীট হও, পুরস্কার জেত কিংবা সংবাদের শিরোনাম হও। বাংলা একাডেমি, গণমাধ্যম আর বাংলাবাজারের মাস্তানরা পরস্পরকে বগলদাবা করে খোদ বইমেলাতে তাদের পরিসর বানিয়ে নিল; বাকিরা দায়সারা প্রতিবাদের আয়োজনে নিজেরা কতটা পিছু হটলেন, তা মাপজোক করা আর হলো না, এর মাঝেই ঘটে গেল অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড।

হিজবুত কিংবা শিবিরের তরুণদের কথা ধরুন, এরা কি এই গোটা অসহিষ্ণু শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ফলাফল নয়? প্রতিদিন কমছে এই দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা, তারও চেয়ে দ্রুতহারে কমছে বিজ্ঞানচেতনা। ব্যবসায় প্রশাসন যে দেশে শিক্ষার প্রায় একমাত্র খাত, রাজনীতি-অর্থনীতি-দর্শন-ইতিহাসের বোধ সে দেশে ক্রমাগত শূন্যই তো হয়ে যাওয়ার কথা।

গোপন জঙ্গি সংগঠনগুলোর কথাও ভাবতে পারেন। বাংলাভাইয়ের মতো ব্যক্তি ও সংগঠন গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে, সেটা প্রথম দিন থেকেই পরিষ্কার ছিল। ঘটনার পরম্পরায় বাংলাভাই নিকেশ হয়েছে, কিন্তু এর সাথে রাষ্ট্রের ইন্ধন কিভাবে কাজ করেছে, তার তদন্ত কই, পর্যালোচনা কই?

৩.

আমাদের কি তাহলে একটা খাঁচায় আটকে রাখার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে না, যেখানে গরিব কৃষক-পোশাকশিল্পের কর্মী আর প্রবাসী শ্রমিকরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবেন, করের টাকায় কোষাগার পূর্ণ করবেন, আর সেই টাকা লুট করবে ঋণ খেলাপিরা, লুট করবে উড়াল সেতুর ঠিকাদাররা, লুট করবে আর সব মাফিয়া রাজনীতিবিদরা। তাই নিয়ে হবে তাদের ক্ষমতার কামড়াকামড়ি। আর বাকি জনগণকে আতঙ্কে রাখতে, বশ রাখতে, অনুগত রাখতে টিকিয়ে রাখা হবে, সহ্য করা হবে, মদদ দেওয়া হবে এই নারকীয় শক্তিগুলোকে?

সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার এই দেশে হচ্ছে না। দেশি-বিদেশি শক্তিগুলোর সাথে মৌলবাদী রাজনীতির গাঁটছড়া নিয়ে কোনো আইন হয়নি। সমাজে অসহিষ্ণুতা যখন খুনের মানসিকতার এত তীব্র বিস্তার ঘটিয়েছে, আপনার বর্তমান বা ভবিষ্যতের কোনো স্বাভাবিকত্ব নিরাপদ? বিদেশে পালিয়ে যদি রেহাই না পেতে চান, দেশকে যদি রক্ষা করতে চান, উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুজে থাকবেন না। মৌলবাদ আজকের দুনিয়ায় কোনো রকম ব্যতিক্রম ছাড়াই লুণ্ঠকদের রাজনীতির পরজীবী। বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি-মানবিকতার নতুন নির্মাণে অংশ নিন, সাধ্যমতো ভূমিকা রাখুন। লুণ্ঠকদের, মৌলবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদের প্রত্যাখ্যান করুন, প্রতিহত করুন।

৪.

আমি একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজি, পুলিশ কেন এত কাছে, কয়েক গজ দূরে থেকেও কিছু বলল না। আমি বিশ্বাস করি না যে পুলিশ খুনের অংশ। আমি এটাও বিশ্বাস করি না যে, অভিজিৎ রায়কে পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আদৌ চিনত, তাকে নিয়ে যে এত এত আলোচনা হচ্ছে, সে বিষয়ে তারা আদৌ সচেতন ছিল। আমি বিশ্বাসও করি না যে, আমার অদেখা জিরো ডিগ্রি ছবির দৃশ্যের মতো কোনো নারী প্রকাশ্য দিবালোকে কাউকে কুপিয়ে হত্যা করছে, আর পুলিশ আদৌ তাকে ধরারও চেষ্টা করছে না- এতটা বিকারহীন। বহু বিপরীত দৃশ্যের কথা আমরা জানি, যেখানে সাধারণ মানুষ কিংবা পুলিশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহতকে রক্ষার কিংবা অপরাধীকে ধরার চেষ্টা করেছে। একটা বিরাট ‘যদি’ আছে... অভিজিৎ রায়কে না চেনা পুলিশ যদি মস্ত একটা ভুল করে, যদি একটা মস্ত ভুল বোঝাবুঝি হয়, যদি তারা ভেবে থাকে শিবিরের কাউকে গণপিটুনি দিচ্ছে ‘জনতা’, কিংবা ‘নিজেদের’ ভেতর ‘মারামারি’ হচ্ছে, ওপর মহলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়ই তো তাদের থাকার কথা। এর বাইরে অন্য যেকোনো মুহূর্তে তাদের সক্রিয় হওয়ারই কথা।

হয়তো, সেই সুযোগটাই নিয়েছে অভিজিৎ রায়ের খুনি। সেই জন্যই, এই নতুন ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধেও দাঁড়ান। খুব স্পষ্ট করে বলুন, যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই, কিন্তু গণতন্ত্রের সাথে তার কোনো বিরোধ নেই। জঙ্গি রাজনীতির উচ্ছেদ চাই, সেটা আইন করে করো, তবে চাপাতি-পিস্তল হাতে গুণ্ডাবাহিনী পাঠিয়ে নয়। মৌলবাদ নির্মূলের প্রশ্নে আন্তরিকতা যদি দেখাতে চাও, দুইবেলা খাবারের বন্দোবস্তসহ সব শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠাবার বন্দোবস্ত কর। খবরদার টাকা নাই বলবা না, এক পুঁজি বাজারে যত টাকা লুট করছ, কিংবা হলমার্কে অথবা উড়াল সেতুতে, এই টাকা তার তুলনায় নস্যি।

৫.

অভিজিৎ রায়ের শারীরিক খুনি হয়তো অল্প কজনই। কিন্তু এই খুনের জমিন তৈরি যারা করেছে, তারা সংখ্যায় অল্প নয়। অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীদের অবিলম্বে বিচার চাই। একই সাথে চাই সমাজে-রাষ্ট্রে এই পাপের খাঁচার মূলোৎপাটনের শক্তিরও উদ্বোধন।

ফিরোজ আহমেদ, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন।