স্মরণ

স্মরণীয় বরণীয় মাহবুব আলী খান

Looks like you've blocked notifications!

‘দিন যায় মাস যায় সময় কাহারও নয়, বেগে ধায় নাহি রহে স্থির ...... আয়ু যেন পদ্মপত্রে নীর’

মহাকালের তুলনায় মানুষের আয়ুষ্কাল নিতান্তই ক্ষীণ। কবির ভাষায়, এটি হচ্ছে পদ্মপাতার ওপর জমে থাকা এক ফোঁটা পানির মতো। টলমল করতে করতে কখন যে ঝরে যাবে তার কোনো ঠিক নেই।

খুব সংক্ষিপ্ত আর ক্ষীণ এই আয়ুষ্কালের মধ্যেও কিছু কিছু মানুষ সুকৃতি নির্মাণ করেন, যার ফলে চিরকাল তারা মানুষের অন্তরে জীবিত থাকেন। তাঁদের আদর্শ, জীবনধারা মানুষের জন্য অনুস্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যোগাযোগ উপদেষ্টা, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও সাবেক নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান (এমএ খান) ছিলেন সে রকমই এক মহান পুরুষ। যত দিন জীবিত ছিলেন দেশের জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করেছেন। তাঁর দেশপ্রেম, কর্মনিষ্ঠা, দক্ষতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আজও আমাদের অন্তরে শ্রদ্ধা ও সমীহ জাগায়। তিনি ছিলেন খুবই অমায়িক। অবসরে প্রচুর পড়াশুনা করতেন। নৌবিদ্যা, সমরবিদ্যা তাঁর পেশার অন্তর্গত ছিল। এ ছাড়া দর্শন, আইন, সমাজসেবা ও ধর্মীয় বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল সুগভীর।  কর্মজীবনে তাঁর সততা ছিল নিখাদ। তাঁর গুণ, জ্ঞান, বাচনভঙ্গি ও আচরণেই আভিজাত্যের ঝলক উদ্ভাসিত হতো।

আজ ৬ আগস্ট তাঁর ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৪ সালের এই দিনে তিনি আকস্মিক পরলোকগমন করেন। বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান দূর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল। তাতে হতাহত হয়েছিলেন কয়েকজন। রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান সেখানে পরিদর্শন করতে তেজগাঁও বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন সকালবেলা। দুর্ঘটনার চিত্র দেখে অন্তরে কষ্ট পেয়ে তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন।  তৎক্ষণাৎ তাঁকে চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে নিয়ে আসা হয়।  সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।

অন্যের দুঃখ-কষ্টে সংবেদনশীল এই মানুষটি সারা জীবন জনকল্যাণে নিবেদিত থাকার চেষ্টা করেছেন।  ধানমণ্ডি ৫ নং সড়কে তাঁরই প্রণোদনায় তাঁর স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু অনাথ, এতিম, দরিদ্র শিশুদের জন্য ‘সুরভী’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন।  সেখানে শিশুদের রোজ একবেলা খাবারসহ বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হয়।  বই-পুস্তক, পোশাকসহ অন্যান্য উপকরণের খরচও স্কুলটি বহন করে থাকে। শিক্ষা ও সেবার উচ্চতর মানের কারণে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।  সারা দেশে সুরভির শতাধিক শাখা মানবতার সেবায় কাজ করছে।

এম এ খান ‘পেট লাভার’ হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন।  তাঁর পোষা প্রিয় বিড়ালটির নাম ছিল ‘পুষি’। মানুষের যেমন যত্ন  নিতে হয় তেমনি তিনি পোষা বিড়ালটিরও যত্ন নিতেন।  তার খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা থেকে শুরু করে জামাকাপড় পর্যন্ত বানিয়ে দিতেন। ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসের দিকে হঠাৎ করেই তাঁর সেই আদরের ‘পুষি’ মারা গেল। তিনি অনেক যত্ন  করে সুরভি স্কুলের চত্বরেই তাকে সমাধিস্থ করলেন। ‘পুষি’র মৃত্যুতে তিনি এতটাই মর্মাহত হয়েছিলেন যে, ঠাঁয় তিন ঘণ্টা ওই সমাধির পাশে বসে নীরবে রোদন করেছেন। বড় বিচিত্র আর বিস্ময় এই যে, তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগেই এই ঘটনা ঘটেছিল।

এই মহৎ-হৃদয় মানুষটির জন্ম ১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর সিলেট জেলার বিরাহীমপুরের এক সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত মুসলিম পরিবারে। তাঁর বাবা আহমেদ আলী খান প্রথম মুসলিম হিসেবে তৎকালীন ভারতে ১৯০১ সালে ব্যারিস্টার হন। তিনি নিখিল ভারত আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রিও অর্জন করেন। হায়দরাবাদের ‘নিজাম’-এর প্রধান আইন উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।

এম এ খানের মা ছিলেন জুবাইদা খাতুন। তিনি বিহার, আসাম ও উড়িষ্যার জমিদার পরিবারের খান বাহাদুর ওয়াসিউদ্দিন আহমেদের মেয়ে।  মরহুমা জুবাইদা খাতুনের দাদা ছিলেন ব্রিটিশদের থেকে ‘অর্ডার অব এমপায়ার’  (Officer of the Most Excellent Order of the British Empire - OBE) খেতাবপ্রাপ্ত। এম এ খানের চাচা গজনফর আলী খান ১৮৯৭ সালে ভারতে চতুর্থ মুসলিম হিসেবে আইসিএস ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে ব্রিটিশদের থেকে অর্ডার অব এমপায়ার খেতাব পান।

এম এ খানের দাদা ছিলেন তৎকালীন ভারতের বিশিষ্ট চিকিৎসক খান বাহাদুর আজদার আলী খান। তিনি বিহার ও আসামের দারভাঙ্গা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং পাটনা মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯২৪ সালে সিলেটে নাফিজা বানু চ্যারিটেবল হাসপাতাল এবং ১৯৩০ সালে ম্যাটার্নিটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

এম এ খানের বাবার মামা জাস্টিস আমির আলী কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপ্রতি ছিলেন। এম এ খানের দাদা খান বাহাদুর আজদার আলী ছিলেন স্যার সৈয়দ আমীর আলীর জামাতা। স্যার সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন ইংল্যান্ডের রয়েল প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য এবং ইন্ডিয়ান ভাইসরয়েজ এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য। স্যার সৈয়দ আলীর বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হলো ‘হিস্ট্রি অব সারাসেন’ ও ‘স্পিরিট অব ইসলাম’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন এম এ খানের চাচাতো ভাই।  শের-এ সিলেট ও অবিভক্ত পাকিস্তানের মন্ত্রী আজমল আলী চৌধুরীও তাঁর চাচাতো ভাই।  দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে এম এ খান ছোট।  সবার বড় বোন সাজেদা বেগম। মেজ ভাই বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার সেকেন্দার আলী খান। মরহুম ডা. সেকেন্ডার আলী খানের মেয়ে আইরিন খান, যিনি মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্ট্যারন্যাশনালের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল।

সিলেটের বিরাহীমপুর, কলকাতা ও পুরান ঢাকার ৬৭ পুরানা পল্টন লাইনের বাড়িতে এম এ খানের শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয়।  তিনি কলকাতা ও ঢাকায় শিক্ষা লাভ করেন।  ছোটবেলা থেকেই ছিলেন শান্ত, ধীর ও চিন্তাশীল। ক্লান্তিময় চেহারা, সুঠাম শরীর ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভিব্যক্তির কারণে পরিবারের মধ্যমণি ছিলেন। আত্মীয়-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবারই প্রিয় ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা করতেন। ব্যাডমিন্টন খেলায় পারদর্শী ছিলেন। খেলা নিয়ে ভাইদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদও হতো। পুরানা পল্টন লাইনের বাড়িতে সামনের খালি জায়গায় ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট কেটে ভাইবোনরা দিন রাত খেলতেন। ধর্মের প্রতি ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। প্রতিদিন সকালে নামাজ আদায় করে পবিত্র কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করতেন।  যেকোনো কাজে বের হওয়ার আগে তিনি আল্লাহকে স্মরণ করতেন। 

১৯৫২ সালে এম এ খান পাকিস্তান নৌবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন ।  ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধানের পদে উন্নীত হন।  মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ওই পদে নিয়োজিত ছিলেন।  মাঝখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ১৯৭৫ সালের পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টা, ১৯৮২ সালের জুলাইয়ে যোগাযোগ উপদেষ্টা ও পরে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।  তিনি যোগাযোগ উপদেষ্টা থাকাকালে দেশের যোগাযোগ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।  ওই সময়ে তিনি দিবারাত্র অবিশ্রান্ত কাজ করেছেন। ঢাকা-সিলেট রোডে সুরমা নদীর উপর লামাকাজী এলাকায় ‘এম এ খান সেতু’ আজও তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে।  কৃষি বিপ্লবের পরিকল্পনা তাঁর মাথায় ছিল।  অকাল মৃত্যুর কারণে সেটি আর হয়ে ওঠেনি।

ব্যাক্তিগত জীবনে এম এ খান সহজ, সরল, মিশুক ছিলেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন।  বেশ ভোজনরসিকও ছিলেন।  গলদা চিংড়ি, ইলিশ মাছ খুব পছন্দ করতেন।  ১৯৫৫ সালে তিনি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন।  তাদের দুই মেয়ে  শাহিনা খান জামান (বিন্দু) এবং ডা. জুবাইদা রহমান (ঝুনু) । শাহিনা খান জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়াশুনা করেছেন। ছোট মেয়ে জুবাইদা রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেছেন।  এরপর তিনি ব্রিটের ইমপেরিয়াল কলেজ থেকে প্রিভেনটিভ কারডিওলজির ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রিতে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন।  বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডোর সৈয়দ শফিউজ্জামান এম এ খানের জেষ্ট জামাতা।  তিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। আর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এম এ খানের কনিষ্ঠ জামাতা। তারেক রহমান ও জুবাইদা রহমানের কন্যা জায়মা রহমান এম এ খানের একমাত্র নাতনি।

লেখক : সাংবাদিক