প্রতিক্রিয়া

একজন ঐশী, সময় ও সমাজের বার্তা

Looks like you've blocked notifications!

আজ ১২ নভেম্বর, সকাল থেকে সময়টা একটু অন্যরকম। নিউজরুমে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার বিষয় একটাই, ঐশীর কী হবে? কেউ কেউ বাজিও ধরেছিল। এটা হতে পারে, ওটা হতে পারে। যেহেতু বিচারের ভার নেই, তাই মন্তব্যেও খানিকটা উদার হয়েছিলাম আমরা। কিন্তু বিচারক বুঝিয়ে দিলেন বিচার ব্যবস্থায় উদার হওয়ার সুযোগ নেই। ২৭ মাস আগে রাজধানীর চামেলীবাগে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান এবং তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে মেয়ে ঐশীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের আদেশ দেওয়া হলো। রহমান দম্পতির এই মেয়ে খুনি অভিযুক্ত হওয়ার সময়ও যেমন বিষয়টা সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তেমনি রায়টাও যেন অনেক না বলা কথার সূত্রপাত ঘটায়। সাধারণত নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারে মা-বাবার সাথে সন্তানের বনিবনা না হওয়া বা এর কারণে সৃষ্ট নানা বিপত্তির খবর এলেও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোও যে তলে তলে ক্ষয়ে যাচ্ছে তা আমরা আকছারই জানতে পারতাম। কারণ তাদের সব খবর বাইরে আসে না।

জানা যায়, ঠান্ডা মাথায় দীর্ঘ সময় নিয়ে ঐশী প্রথমে মাকে হত্যা করে। পরে বিপদ হবে জেনে ছুরি দিয়ে খুন করে বাবাকে। এর আগে দুজনের কফির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয় ঘুমের ওষুধ। একটা মেয়ে কতটা পরিবারের প্রতি বিরক্ত হলে এই কাজটি করতে পারে? তাহলে কি ঐশীর বড় হয়ে উঠার মধ্যেই রয়ে গেছে বড় ধরনের গলদ? যেহেতু মৃত্যু মানুষকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়, তাই হয়তো রহমান দম্পতির সরাসরি সমালোচনা না করেও বলা যায়, এই খুনের পেছনে তাদের দায়ও কম নয়। কোথায় জানি পড়েছিলাম, ‘বাবা-মায়ে ঝগড়া করে ছেলেমেয়ে দেখে, জাহান্নামের সদর দরজায় বাছাগুলোরে রাখে।’ এ কথা ধরেই নিতে হয়, যে পরিবারে ঐশী বেড়ে উঠছিল সেখানে স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও হয়তো সুখ ছিল না। যেমনটি গল্প-উপন্যাসে আমরা পড়ে থাকি। ধনী লোকের চার কামরায় মা-বাবা আর তাদের দুই সন্তান। কারো সঙ্গে কারো তেমন দেখা হয় না। রাতের খাবার সময় হয়তো দেখা হয়। আবার অনেকে এটা নিয়ে গর্বও করে। তারা হয়তো এটা জানে না এই দেখা সবাইকে সমৃদ্ধ করে না। আর করে না বলেই মমত্বের সমাবেশ ঘটে না। তাই ঐশীকে যতবার আদালতে আনতে দেখেছি কোনোবারই তার মধ্যে অনুশোচনার লেশমাত্র ছিল না বরং সে একবার আদালতের কাছে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল বলেও অভিযোগ এনেছিল।

ঢাকার রাস্তায় বড়লোকের বখাটে সন্তানদের কত ঘটনাই তো চোখে পড়ে। দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে ঘুমন্ত মানুষ মেরে ফেলা থেকে শুরু করে নেশার জগতে জড়িয়ে গিয়ে নানা বেলাল্লাপনা। কিন্তু ঐশী আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল তার বয়সের চেয়ে বেশি পেকে যাওয়া আর স্কুলে জনির মতো অসৎসঙ্গে পড়ে নেশার জগতে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে। তার বেড়ে উঠার মধ্যে যেমন গলদ রয়ে গিয়েছিল, তেমনি পরিবারের সাহচর্য না পেয়ে সে জড়িয়ে পড়েছিল ইয়াবার আসক্তিতে। আর এতে বাধা পেলে সে হয়ে উঠত ভয়ংকর। পরে মা-বাবা যখন বাধা দিতে আসেন তখন জল গড়িয়েছে অনেকদূর। সে কারণে পুলিশের কাছে সে স্বীকার করেছে, ‘আমি ছিলাম মায়ের দুচোখের বিষ। মা আমাকে দেখতে পারত না। চরিত্র নিয়ে কথা বলত। বলত তুই আমার মেয়ে না।’ আসলে কৈশোর পেরোনো এই মেয়েকে নেশা এমনভাবে বদলে দিয়েছে যে, সে খুন করার পক্ষেও হয়তো যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলবে।

কিন্তু ঐশীর খুন করা থেকে শুরু করে আদালতের রায় পর্যন্ত আমাদের জন্য অপেক্ষা করে এক ভয়ংকর বার্তা। এক ঐশীর বিচার হচ্ছে কিন্তু আরো কত ঐশীর যে জন্ম হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের অসচেতনতার কারণে। পার্কের প্রবেশ পথে যতই লেখা থাকুক ‘স্কুল ড্রেস পরে প্রবেশ নিষেধ’, তারা ঠিকই প্রবেশ করছে পার্কে। বেশি কড়াকড়ি থাকলেও কোনো প্রক্ষালন কক্ষে ঢুকে পাল্টে নিচ্ছে পোশাক। রেস্টুরেন্টের আলো-আঁধারি পরিবেশ এবং বন্ধুর খালি ফ্ল্যাটে ঘটছে নানা ঘটনা। আর এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় সোনালি ভবিষ্যৎ। কেউ কেউ ভয়ংকর হয়ে উঠছে ঐশীর মতোই। অন্দরমহল এখন অবারিত, অন্তর্জালের ফাঁক দিয়ে এগলি-ওগলির অনেক কিছুই বাঁধা পড়ছে মনের জানলায়। বয়ঃসন্ধিতে যদি ছাকনি দিয়ে মন্দ ঝেড়ে ফেলার পরামর্শ দেওয়া না হয়, সময়ের সাথে সাথে মনে জমবে ময়লা। আর এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে মা-বাবাকে। নইলে এক ঐশীর ফাঁসি দিয়ে সমাজের পরিবর্তন সহজে হবে না। মা-বাবা সন্তানের সামনে পরস্পরের গুণের কথা যদি বলে তা হলে সন্তানের সুমতি হয়। আবার দেখা গেল যখন শাসন করা দরকার তখন শাসন করা হয় না। আবার ছেলেমেয়েদের কোনো ঝোঁক যদি মা-বাবা জোর করে ভেঙে দিতে চায় তাহলেও আসে বিকৃতি। তাই মন্দ ঝোঁক হলেও তাকে কায়দা করে মোড় ঘুরিয়ে দিতে হয়। শিশুকাল থেকে যদি করে-করিয়ে না শেখানো হয়, তাহলে পস্তাতে হবে রহমান দম্পতির মতো। আর এতে হাজারটা ঐশীর ফাঁসি হলেও সমাজ কোনো সুফল পাবে না।

লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, সময় টেলিভিশন