প্রতিক্রিয়া

পক্ষপাতে থমকে না যাক প্রতিবাদের পতাকা

Looks like you've blocked notifications!

সভ্যতার পাদপীঠ প্যারিস। একদিনে নয়, একা নয়, শত-সহস্র বছরের তিলতিল চেষ্টা আর সাধনায় গড়ে উঠেছে এই সভ্যতার গৌরব। শিল্পের অন্তর্নিহিত নান্দনিক শক্তিতে উদ্ভাসিত প্যারিসের প্রতি ইঞ্চি জমিন। সেই প্যারিস আইএস দানবের আকস্মিক থাবায় থমকে গেছে। শুধু প্যারিস নয়, থমকে দিয়েছে মানবিকতার সুর-সংগীতকে। শিল্পের স্বর্গে আজ রক্তস্রোতের বেমানান নদী। ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর নারকীয় থাবায় ঝরে গেছে শতপ্রাণ। এই হত্যাযজ্ঞ স্তম্ভিত করেছে মানবতাকে, মানুষকে। দেশ-জাতি, ধর্ম-বর্ণের যে দেয়াল, যে গণ্ডি মুহূর্তে তা মিশে গেছে, বিশ্বজুড়ে এক সুরে কেঁদে উঠেছে মানবতা। যারা কাঁদেনি, কান্না যাদের স্পর্শ করেনি, তারা ভিনগ্রহের প্রাণী, নরকে বসতি তাদের। মানুষের বিপন্নতায় মানুষ কাঁদবে, কাঁদবে তার মানবিকতা—এটাই মানবধর্ম।

কান্নার সেই ঢেউ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে আছড়ে পড়েছে আমাদের পলি-জলের শ্যামল জমিনেও। আমরা সহমর্মী হয়েছি বোমা-গুলির আঘাতে নিহত পরিবারের। প্যারিসবাসীর বেদনার সহযাত্রী হয়েছি। ক্ষোভ আর ঘৃণায় আমাদের অন্তর্গত যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটিয়েছি। যে যার অবস্থান থেকে যে যেভাবে পারি প্রতিবাদ জানিয়েছি, এখনো সেই প্রতিবাদ জারি রয়েছে, থাকবে, থাকা জরুরি। নিজেদের প্রয়োজনে, মানবতার প্রয়োজনে। এই ঘৃণা, এই প্রতিবাদ যতদিন জাগ্রত থাকবে, ততদিনই অন্ধকারের অশুভ শক্তি আমাদের পদানত থাকবে, নয়তো নয়।

মানুষের একটি সর্বজনীন ধর্ম আছে, সহজাত বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষ নিজেরা নিজেদের গণ্ডিতে যত আত্মকলহেই নিমজ্জিত থাকুক না কেন, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, অন্য যেকোনো মানুষের কান্না, তাদের অসহায়ত্ব মানুষকে স্পর্শ করে। সহমর্মীবোধে তারও অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে। শারীরিক উপস্থিতিতে সে পারুক আর নাই পারুক, মানসিকভাবে সে সেই বিপন্ন মানুষটির পাশে দাঁড়ায়। দেশ, ধর্ম, জাতির ভেদরেখা ছিঁড়ে ফেলে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়, প্রতিবাদ জানায় তার মতো করে। কখনো মিছিলে, কখনো আঁধার রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে, কখনো পিচঢালা পথে হাতে হাত রেখে মানববন্ধন করে। সভা করে, কবিতা লিখে প্যারিস গণহত্যার পর আমাদের দেশেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আমরা শত কষ্ট-যন্ত্রণার মধ্যেও এই বর্বতার প্রতিবাদ জানিয়েছি, ঘৃণা প্রকাশ করেছি। সভ্যতা, মানবতাবিরুদ্ধ অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে মানুষকে জাগতে বলেছি, জেগে থাকার আহ্বান জানিয়েছি। আমাদের প্রতিবাদের, ক্ষোভের, সহমর্মিতার প্রতীক হয়ে অন্তর্জাল ছেয়ে গেছে ফরাসি পতাকার নীল-সাদা-লালের আবহে। আমরা রাস্তায় নামিনি সত্য, আমরা পথে পথে চিৎকার করে বলিনি, রাজপথে মিছিল করিনি, সভা করে সমস্বরে আওয়াজ তুলিনি সত্য; কিন্তু চলতি সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ব্লগকে প্রতিবাদ-ঘৃণা আর সহমর্মিতার উদার জমিনে পরিণত করেছি হ্যাশট্যাগ চিহ্ন দিয়ে, প্রার্থনা করছি প্যারিসের জন্য, বলছি বন্ধ করো এই গণহত্যা, বন্ধ করো বর্বরতা। আমাদের ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারকে বদলে দিয়েছি ফরাসি পতাকার রঙে। এ এক অভাবিত জাগরণ। জাগ্রত মানুষের সরব উপস্থিতি। এমন জাগরণ আমাদের আশাবাদী করে।

এমন জাগরণ, একতা আমাদের মধ্যে অতীতে কখনোই দেখিনি কিংবা দেখাতে পারিনি। ফিলিস্তিন, গাজায় ইসরায়েলি সেনারা গুলি-বোমা-বেয়নেটের ডগায় যখন শত শত শিশুকে হত্যা করেছিল, তখনো এমন জাগরণ দেখিনি। গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মিথ্যা অজুহাতে প্রাচীন সভ্যতার আরেক সূতিকাগার ইরাকে যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার পশ্চিমা মিত্ররা নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে হাজার হাজার নারী-শিশুকে হত্যা করেছে, ধ্বংস করেছে জনপদের পর জনপদ, তখন আমরা এমন প্রতিবাদে একসঙ্গে দাঁড়াইনি। লিবিয়ার ধ্বংসযজ্ঞে প্রতিবাদী সুর, সহমর্মিতা দেখিনি। এই তো সেদিন, লেবাননে বোমা হামলায় অর্ধশতাধিক মানুষকে মেরে ফেলা হলো। কোনো হ্যাশট্যাগ নজরে পড়েনি। পাকিস্তান কিংবা ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জঙ্গি হামলায় ইন্টারনেটে ফেসবুকে প্রতিবাদের ঢেউ জাগেনি। অথচ প্রতিটি বর্বর হামলার শিকার হয়েছে সাধারণ, নিষ্পাপ মানুষ। পদদলিত হয়েছে মানবতা। আইএস, তালেবানি শক্তি ধর্মের অন্ধত্ব, উগ্রতার শক্তি থেকে যখন গণহত্যা চালায়, তখন যেমন মানবতা-প্রগতি পদদলিত হয়, ঠিক তেমনি করেই মানবতা-প্রগতি পদদলিত হয় ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরায়েলি হামলায় অসহায় নারী-শিশুর গণমৃত্যুতে। আমরা প্রতিবাদ জানাব, ক্ষোভ-ঘৃণায় ঝলসে দেব দানবের মুখ। ভিনদেশি পতাকার আবরণে নিজেদের ঢাকব, সহমর্মী হবো, এটাই কাম্য। কিন্তু আমরা যেন অতীতের মতো আসন্ন আঁধার সময়ের গণহত্যা, মানবতার পদদলনে ধর্ম না দেখি, জাত-বর্ণ, দেশ না দেখি। রাজনীতি-ক্ষমতার কুট চিন্তা, স্বার্থপরতায় নিজের বিবেককে বন্দি না রাখি। পক্ষপাতের কুষ্ঠুরোগে যেন থমকে না যায় প্রতিবাদের পতাকা।

ভয় আর শঙ্কায় ভাসমান সময়ে আমরা যেন ভুলে না যাই মানবতার কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই, গোষ্ঠী নেই, দেশ যেমন নেই। তেমনি মানবতা দলনে উন্মত্ত দানবদের রক্তেরও কোনো প্রভেদ নেই। প্রতিবাদ হোক অবারিত, সহমর্মিতা থাকুক সর্বজনীন। সবার ঊর্ধ্বে যেন থাকে মানুষ, মানবতার জয়গান। না হলে সব প্রতিবাদ হবে অর্থহীন প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ভণ্ডামি।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।