চীন হটাতে এশিয়ায় নতুন ত্রিদেশীয় জোট

Looks like you've blocked notifications!
ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির মূলে গণতন্ত্র নেই। আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের অঙ্গীকার নিয়ে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ওই প্রতিশ্রুতিতে দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের আদলে গড়ে তোলার কোনো বিষয় নেই। আরব বসন্ত রূপ নিয়েছে দুঃস্বপ্নে, কায়রো ও রিয়াদে ওবামা প্রশাসনের প্রভাব আবার দৃঢ় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই মস্কো, বেইজিং, তেহরান ও হাভানার ভালো সম্পর্ক দেখা গেছে। তবে গত মাসে ভারতে ওবামার সফরে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের নতুন মোড় নিয়েছে। একই সঙ্গে জাপান-ভারত সম্পর্কেরও উন্নতি হয়েছে। এতে ত্রিদেশীয় জোটের দৃঢ়তার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। 

ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের পদক্ষেপই অনুসরণ করেছেন ওবামা। ২০০৬ সালে আবে বলেছিলেন, জাপান-ভারত সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন ও টোকিওর সঙ্গে দেশের সম্পর্ককে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছ্নে।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছে জাপান ও ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করে আগে দেশ দুটির নীতি ছিল মূল্যবোধভিত্তিক কূটনীতি। বর্তমানে তিনটি দেশই বুঝতে পেরেছে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তিশালী জোট করতে হলে জাতীয় সুবিধা ও রাজনৈতিক মতের ভিত্তিতে কূটনীতি গ্রহণ করতে হবে।

তিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে উঠে এসেছেন ওবামা, আবে ও মোদি। কিন্তু তাঁদের বর্তমান লক্ষ্য একই, এশিয়ায় চীনের প্রভাব খর্ব করা। যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-ভারত সম্পর্ক চীনের জন্যও হুমকির। 

এশিয়ার ওপর চীনের প্রভাব খর্ব করতে জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ২০১১ সালে ত্রিদেশীয় কৌশল ঘোষণা করে। বর্তমানে তারা ত্রিদেশীয় সম্পর্ক গভীর করতে সম্মত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমুদ্রসীমায় নিরাপত্তা জোরদারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

ত্রিদেশীয় সম্পর্ককে বর্ধিত করতে অস্ট্রেলিয়াকে এর সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই চার দেশ ২০০৭ সালে এশিয়ার সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়ার পরিকল্পনা করে। স্বভাবতই চীন এর বিরোধিতা করেছে। চীনের দাবি, এটি ‘এশীয় ন্যাটো’।

সাম্প্রতিক সময়ে চীনের কূটনীতিতে ভালো কোনো অর্জন নেই। যুক্তরাষ্ট্র এ সুযোগে এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। 

বর্তমান ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি ভারতের জন্য নতুন। বরাবরই তারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘সহযোগী রাষ্ট্রব্যবস্থা’র বিরোধী ছিল। অর্থনীতিতে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে আছে ভারতের ‘একলা চলো’ নীতি। তবে সেখান থেকে আবারও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে উঠে আসছে দেশটি। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পাশাপাশি তাদের অর্থনীতিও বিস্তৃত হচ্ছে।

২০১৪ সালে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশটির অর্থনীতি চীনের চেয়েও দ্রুত এগোচ্ছে। অন্যদিকে, চীনের অর্থনীতির অগ্রগতি হচ্ছে ধীরে। এশিয়ার অনেক দেশই ভারতের অগ্রগতিতে স্বস্তি বোধ করছে। কারণ, তারা একে নিজেদের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ হিসেবে দেখছে। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এশিয়ায় চীনের চেয়ে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস ও টোকিওর কাছে ভারত সহযোগী দেশ হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু চীনকে তারা প্রতিযোগী বলেই মনে করে। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা গত মাসে ভারত সফরকালে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো গভীর করার ওপর জোর দেন। আর ২০১৪ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ভারত সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। ওই সময় ভারত ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী চীন নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যেই চীনকে অষ্টাদশ শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের দেশ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চীন অনেক অঞ্চল দখলের পাঁয়তারা করছে। যুক্তরাষ্ট্রেরও একই অভিযোগ রয়েছে। 

চীন যে বসে আছে, তা নয়। চীনের অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিও উত্তরোত্তর বাড়ছে। তবে ত্রিদেশীয় শক্তির কথা চিন্তা করলে সেই অগ্রগতি অনেক ধীর। 

যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান উভয় দেশের মতেই ভারত এমন একটি দেশ, যা চীনের অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিকে খর্ব করার মতো ক্ষমতা রাখে। ইরান উপসাগরের তেল ও গ্যাস এশিয়ায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দেশটির নৌবাহিনী।

একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতোই জঙ্গিবাদের শিকার ভারত। তাই অর্থনীতি বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতকে নিরাপত্তার বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। নিরাপত্তা বিস্তৃত করতে হবে পূর্ব আফ্রিকা থেকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের নিরাপত্তা বাড়াতে হতে পারে, কারণ প্রায় ৭০ লাখ ভারতীয় সেখানে বসবাস করে। সামরিক শক্তি বাড়াতে ভারতের প্রয়োজন অর্থ, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষার যন্ত্রাংশ। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান এগুলোর সবচেয়ে বড় জোগানদার। তাই ভারতের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাজি হবে ত্রিপক্ষীয় জোট। 

ভারত ও জাপানের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিলটি হলো উভয়েই গণতান্ত্রিক। আর যুক্তরাষ্ট্রও গণতন্ত্রের কথা বলে। এশিয়ায় গণতন্ত্র শক্তিশালী করাই হতে পারে তাদের সম্পর্কের একটি বড় ম্যান্ডেট। ফলে গণতন্ত্রও ত্রিদেশীয় জোটের পররাষ্ট্রনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ড্যানিয়েল টুইনিংয়ের বিশ্লেষণ অবলম্বনে।