প্যারিস হামলা

ফেসবুকের প্রোপিকে পতাকার তিন রং

Looks like you've blocked notifications!

আমি মনে করি না, কোনো দেশের পতাকা দিয়ে সেই দেশের অধিবাসীদের সামগ্রিকতাকে ধারণ করা যায়। ইতিহাস সাক্ষী, জাতীয় পতাকাকে একটি দেশের সাধারণ জনগণ তার স্বার্থে যতবার ব্যবহার করতে পেরেছে তারচেয়ে হাজারগুণ বেশি তা ব্যবহৃত হয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসক গোষ্ঠীর নিজস্ব স্বার্থে। জাতীয় পতাকাকে সামনে এনে এবং তার বিমূর্ত পবিত্রতা ঘোষণা করে অনেক আগ্রাসী দেশের সরকার তার অপকর্মকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে, এখনো সেটা করা হয়ে থাকে। যেকোনো সৎ অনুসন্ধানেই দেখা যাবে, যে দেশের সরকার নিজ দেশ এবং অন্যত্র জনগণের প্রতি যত বেশি অপরাধমূলক তৎপরতা পরিচালনা করে, পতাকার পবিত্রতা ঘোষণার হার তাদের ক্ষেত্রে তত বেশি। ২০০১ সালের পর থেকে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে 'সন্ত্রাসবাদবিরোধী অনন্ত যুদ্ধে'র সম্প্রসারণ বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের পতাকার 'ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ' প্রদর্শনীও বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার লক্ষ্যণীয় হলো, কোনো দেশের সন্ত্রাসী অপকর্ম কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আক্রান্ত দেশের জনগণ সেই দেশের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের বিপক্ষে নয়, বরং আগ্রাসী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধেই তাদের ঘৃণা প্রকাশ পায়।

তবে কোনো দেশের জনগণ যদি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নিয়োজিত থাকে, সেখানে জাতীয় পতাকার বিষয়টি ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

প্রোফাইল পিকচারে পতাকা দিতে হলে প্রতিদিন কয়েকবার করে পতাকা পরিবর্তন করতে হয়, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, লেবানন থেকে শুরু করে আফ্রিকা কিংবা লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের পতাকাই সেখানে লাগানো যেতে পারে। কেননা এসব দেশই প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসের শিকার, অজস্র মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরণ করছে এই সব দেশে : কোথাও রাষ্ট্রীয় পেটোয়া বাহিনীর হাতে, কোথাও জঙ্গি সন্ত্রাসী নামে প্রচারিত গোষ্ঠীর আক্রমণে, কোথাও বা আত্মঘাতী বোমা হামলায়, আবার কোথাও সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের আঘাতে। দিন শেষে নিরীহ সাধারণ মানুষই মারা যাচ্ছে। প্যারিস 'শিল্প-সভ্যতার রাজধানী' তাই সেখানকার মানুষজন সমবেদনা পাওয়ার অধিকারী, আর প্রাচ্যের নাগরিকরা 'অশিক্ষিত'. 'বর্বর' তাই তাদের 'মরে যাওয়াই উচিত' এই বিচিত্র চিন্তা যদি কারো অন্তকরণে অসচেতনভাবেও উদিত হয়ে থাকে তাহলে তাকে সমর্থন জানানোর কোনো কারণ দেখি না। মাত্রই বৃহস্পতিবার বৈরুতে বোমা হামলায় ৪৩ জন নিরীহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। ফ্রান্সের মতো এখানেও হামলার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট। কিন্তু এই বিষয়ে ফেসবুকে তুলনামূলক অস্বাভাবিক নীরবতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

গত বছরের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পেশোয়ারে তালেবানদের হামলায় প্যারিসের ঘটনার প্রায় সমসংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছিল, যাদের বেশির ভাগই ছিল ছোট শিশু। এই ঘটনায় অনেককে নিন্দা-প্রতিবাদ করতে দেখা গেলেও তাদের কেউই প্রোফাইলে পাকিস্তানের পতাকা ঝোলাননি। বিষয়টি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিলে তাঁরা হয়তো বলবেন, পাকিস্তানি শিশুদের এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে তারা দুঃখিত, কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রকে তারা ঘৃণা করেন বলে তার পতাকা প্রদর্শন করা তাদের জন্য সম্ভব নয়। এই যুক্তি মেনে নিলে আমাদের কিন্তু আবার প্রথম কথায় ফিরে আসতে হয়।আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, সেটা হলো ফেসবুক কর্তৃপক্ষও অন্য হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এমন অপশন চালু করেনি।

প্যারিসে হামলা ফ্রান্সের একান্ত নিজস্ব কোনো বিষয় নয়। ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ কোনো কারণ থেকে এই ঘটনা উদ্ভূত হয়নি। অনেকে বিগত শতকে আলজেরিয়া কিংবা মরক্কোয় ফ্রান্সের বর্বরতার কথা উল্লেখ করে একে পরোক্ষ বৈধতা দিতে চাইছেন কিংবা ইঙ্গিত করতে চাইছেন এই দুই বিষয়ের মধ্যে যোগসূত্র আছে, আমি সেটাও সঠিক মনে করি না। এই হামলা প্যারিসে না হয়ে বার্লিন কিংবা রোমে অথবা বুদাপেস্টেও হতে পারত, তাতে এর গুরুত্ব কিছু বাড়ত-কমত না। এর আগে লন্ডনে, মাদ্রিদে আমরা এ ধরনের বোমা হামলার ঘটনা ঘটতে দেখেছি। এ ছাড়া বোমাহামলাসহ কথিত সন্ত্রাসী আক্রমণে ভারতসহ আরো অনেক দেশেই অজস্র প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং ফ্রান্সের পতাকা সামনে এনে একে ফ্রান্সের বিষয় হিসেবে সীমিত করে ফেলার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বাস্তবিকই এই ধরনের ঘটনা নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই ঘটে চলেছে। এই হামলার সাথে আন্তর্জাতিক আগ্রাসন এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতি জড়িত। এটাকে সেভাবেই দেখতে হবে।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ লেখক শিবির এবং সম্পাদক, পাঠচক্র।