নারীর জীবন

মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হলেই বা কী

Looks like you've blocked notifications!

কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যক্তিগত প্রোফাইলে দুটো প্রশ্ন করেছিলাম। সেগুলো হলো :

১. উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের কাছ থেকে জাতি কী চায়?

২. মাতা-পিতা কেন মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত বানাতে চান?

প্রথমটির উত্তর এমন এসেছে, যার সারমর্ম হতে পারে—‘শিক্ষিত বাড়ির বউ’ পাওয়ার জন্য মেয়েদের পড়ানো হয়। যদিও তাতে ‘হালকা সুর’ ছিল বেশ। কেউ কেউ আবার ইঙ্গিতে শ্বশুরবাড়িকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন! অন্যদিকে দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে অনেকেই জোর গলায় বলেছেন, বাবা-মা চায় তার মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক।

এবার প্রশ্ন নম্বর তিন!

‘নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর শেষতক চাওয়া কী?’

নানা ধরনের উত্তর আসবে সত্যি! কিন্তু যেটা রূঢ় সত্য তা হলো, আসলেই বাবা-মা তাদের মেয়েদের হয়তো ‘ভালো’ বিয়ে দেওয়ার জন্যই পড়ালেখা করান।

কেন এই ‘হয়তো’ শব্দের আড়ালে হতাশা ফুটে উঠল, সেটা নিয়ে কথা উঠতেই পারে। কেন এই হতাশা, তা জানার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েদের জীবনের দিকে তাকালেই হবে।

ছোটবেলা থেকেই প্রাথমিকভাবে সন্তানদের ‘ছেলে ও মেয়ে’ বিভাজনে বড় করে তোলা এই উপমহাদেশের মজ্জাগত ত্রুটি। ছেলেরা যা করবে, মেয়েরা তা করবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে খেলাধুলার কথা, অনেক সচেতন মাকে দেখেছি মেয়েকে এমন খেলা খেলতে দিচ্ছেন না, যাতে করে তার গায়ের রং কালো হয়ে যায় বা হাতের হাড় শক্ত হয়ে যায়! কিন্তু মেয়েটি চাইছে কি চাইছে না, সেটা বড় কথা না। এই যত্নের সঙ্গে হাত আর ত্বকের সংরক্ষণ কেন?

তাকে একটা সময় ‘তথাকথিত অন্যের ঘরে’ তুলে দেওয়ার জন্যই নয় কী?

আমার ভুল হতে পারে। কিন্তু এটা নিজস্ব বক্তব্য আমার। অনুগ্রহপূর্বক কু-তর্ক জুড়ে না দেওয়ার অনুরোধ রইল!

খেলাধুলা ছাড়াও এমন বহু বিষয় আছে, যেখানে মেয়েদের ঘাড়ে ধরে দেখানো হচ্ছে, তারা কী পারবে আর কী পারবে না। এমনকি পড়ালেখার ব্যাপারেও অনেককে শুনতে হয়, ‘এটা তো মেয়েদের সাবজেক্ট নয়!’ আবার ছেলেদেরও কিছু বিষয় পড়তে মানা করার কারণ ওটা ‘মেয়েদের বিষয়’।

যাই হোক, এ সমাজে নিরাপত্তার একটি বিষয় আছে অবশ্যই। যেটা ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য বিবেচ্য। কিন্তু আজো নিরাপত্তার খাতিরে মেয়েটিকে যেতে দেওয়া হয় না কোনো শিক্ষা সফরেও, এমন উদাহরণের অভাব নেই!

যে মেয়েটাকে জন্ম থেকেই অদৃশ্য জালে ‘সমাজ’ বেঁধে রেখেছে, তার কাছে আসলেই জাতি কি চায়? শুধু ‘শিক্ষার হার বাড়ানোর’ একটি উপাদান হিসেবে বেঁচে থাকা!

এবার যদি বলি চাকরিক্ষেত্রের কথা, এখনো অনেক অফিস ‘মেয়েদের’ চাকরি দিতে নারাজ! আবার এমন অনেক ডাকসাইটে অফিস আছে, যারা অনেক খরচ করলেও মেয়েদের ট্রান্সপোর্ট দিতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। আবার সেই মেয়েটাই যদি পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে লেট নাইট কাজ করতে না চায়, তাহলে ‘মেয়ে’ হিসেবে তার চাকরিক্ষেত্রে যোগ্যতা কমে যায়। এমনিতেও মেয়েদের চাকরি দেওয়ার সময় মহারথীরা ভাবেন, সে কত দিন পিরিয়ডের ছুটি নেবে, কত দিন বিয়ের সময় ছুটি নেবে বা মাতৃত্বকালীন ছুটি নেবে।

ওরে বাবা, তার মানে মেয়েদের চাকরি দেওয়া তো লস প্রজেক্ট!

অথচ পাশের সিটের পুরুষ কলিগটি যে হাঁচি হলেও আসছেন না অফিসে, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ নীরব!

তাও যদি কোনো মেয়ে কোনোভাবে বড় পোস্ট অর্জন করে, তাহলে অবশ্যই ধরে নিতে হবে মেয়েটির কোনো লাফড়া আছে বিগবসের সঙ্গে!

এই হলো এই উপমহাদেশের উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের অবস্থা!

তার পরও নানা গুজব পেছনে ফেলে একটা মেয়ে যখন মা হয়, তখন তাকে কীভাবে সাহায্য করা হচ্ছে ‘নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য?’

যেসব অফিসে মেয়েরা আছে, সেখানে কি চাইল্ড ডে-কেয়ার আছে? মায়েরা কি সন্তানদের নিয়ে অফিস করতে পারছেন? রেখে এলে কার কাছে রেখে আসছেন? সবার বাসায় কি সাহায্য করার মানুষ আছে?

কেউ কি কখনো জানতে চেয়েছেন, মা যখন শিশুকে বাসায় রেখে আসেন, তার মানসিক অবস্থা কেমন থাকে?

এই যে নারী অধিকার নিয়ে এত হৈচৈ, নারীশিক্ষার জন্য দাবি-দাওয়া, সেই শিক্ষিত নারীটার জন্য, তার শিক্ষাটাকে কাজে লাগানোর জন্য কী সুব্যবস্থা করা হচ্ছে?

নাকি শেষমেশ ওই হতাশ শিক্ষিত মা বাসায় বসে পড়বে, শিক্ষিত ঘরের বউ হবে—এই অদৃষ্টকে মেনে নেওয়াই মজ্জাগত অভ্যাস হয়ে গেছে সবার। তাহলে কেন কষ্ট করে পড়ালেখা? কষ্ট করে ডিগ্রি নেওয়া? মেয়েগুলো না হয় ঘরেই থাকুক!

এবার আসুন, যাঁরা শ্বশুরবাড়িকে কটাক্ষ করেন, তাঁরা কি আসলেই বিশ্বাস করেন যে বাবা-মা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর আর কোনো দাবি রাখবেন না মেয়েদের প্রতি? মায়েরা তো শুনেছি, তাদের মেয়েকে রান্না করা শেখান যেন তার সংসারে ভালো আহারের আয়োজন হয়। কোনো ছেলেকে তো শেখান না। আমাকেও আমার মা বলেন, ‘করতে করতে হয়ে যাবে!‘ আমি উত্তর দিই, ‘যেহেতু রান্না করা পছন্দ না, সেহেতু হলে হবে, না হলে নাই।’ বাবা-মা যতই মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কথা বলুক, শেষ দাড়িটা ’সংসারী’ হওয়াতেই পড়ে।

আমার পরিচিত বহু মেয়ের জীবনে দেখেছি, বাবা-মা মেয়েকে বাসায় বসানোর জন্য অস্থির হয়ে থাকেন। হয় বিয়ের পর, না হলে সন্তান হওয়ার পর তো অবশ্যই! শেষতক তারা পরের ঘরে ‘লক্ষ্মী’ করতেই মেয়েটিকে উচ্চশিক্ষা দিচ্ছেন! যাতে বিয়ের ‘তথাকথিত বাজারে’ ভালো পাত্র পাওয়া যায়।

কী জানি, জীবনের খাতায় পাস মার্ক পাওয়া বয়সে এখন সত্যি মনে হয়, উচ্চশিক্ষিত একটি মেয়ে একজন ‘ভালো পাত্রী’ ছাড়া কিছুই নয়। বাই দ্য ওয়ে, ভালো মা বা স্ত্রী হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষার দরকার নেই। সাধারণ জ্ঞান থাকলেই হলো।

আর স্কুল বা কলেজে বা পার্টটাইম জব করে (যা দিয়ে নিজের শপিং বা হাতখরচ চালানো যায়) এমন পাত্রী হলে তো সমাজের চোখে তারা মোটামুটি লক্ষ্মী!

তা না হলে যে মা সন্তান নিয়ে রোজ অমানবিক কষ্ট করেন ও দৈনন্দিন কাজও করেন, তাকে শুনতে হয় তিনি ‘ভালো মা’ নন, রান্না করতে না পারলে আত্মীয়-অনাত্মীয়দের মশকরাও নিত্যদিনের প্রাপ্তি! বাপের বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি এ ব্যাপারে বেশ একদল—যৌথ সরকার!

অতঃপর একটা সময় মেয়েদের সঙ্গী হয়ে যায় টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটক। উচ্চশিক্ষিত মেয়েটি হয় ‘ভালো পাত্রী/স্ত্রী’ এবং তার জীবন হয় ‘জি বাংলা’!

 

লেখক : সাংবাদিক।