ভারতে অসহিষ্ণুতা
সাবাস আমির, আপনার মন্তব্যের জন্য
রানা আইয়ূবের লেখা এই কলামটি এনডিটিভির মতামত পাতা থেকে ভাবানুবাদ করে এখানে দেওয়া হলো। আইয়ূব ভারতের পুরস্কারজয়ী অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
২০০৫ সালের জানুয়ারির কোনো একটা সময়ে বিবিসিতে অ্যাডাম কার্টিস পরিচালিত ‘দুঃস্বপ্নের ক্ষমতা’ শীর্ষক তিন পর্বের তথ্যচিত্র চলাকালে বিবিসি সন্ত্রাস এবং রাজনীতি নিয়ে খুব আঘাত করার মতো কিছু লিখেছিল। আমি সেটি গতকাল সন্ধ্যায় আবারও দেখলাম, কারণ তার সঙ্গে আজকের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে একটা অলৌকিক মিল আছে।
তথ্যচিত্রটি আলকায়েদার গঠনরীতি, সংস্কারনীতি এবং ৯/১১ পরবর্তী রাজনৈতিক মিথ নিয়ে। এটার খুব প্রশংসাসুলভ সমালোচনা করে অনেকে। পূর্বে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যেখানে আরো মানবিক বিশ্বের স্বপ্ন দেখাতেন, সেখানে এখন তারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন দুঃস্বপ্নের হাত থেকে বাঁচানোর। এর মধ্যে সবচেয়ে ভীতিকর হলো, এক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের হুমকি। তবে যেভাবে রাজনীতিবিদদের দেখানো স্বপ্ন সত্যি হয়নি, ঠিক সেভাবে সস্ত্রাসীদের তৈরি দুঃস্বপ্নও সত্যি হতে পারে না।
দুই সপ্তাহ আগে, গত কয়েক বছরে সংগঠিত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী আক্রমণগুলোর একটিতে আক্রান্ত হলো প্যারিস। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে তিনি প্যারিসের প্রতি সমবেদনা জানান। পরে তুরস্কে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে পৃথিবীর সকলকে অবশ্যই একনীতি এবং একপন্থা অবলম্বন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য সব রাজনৈতিক বিবেচনা পরিহার করতে হবে। যারা সন্ত্রাসীদের মদদ দেবে তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে যারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তাদের সঙ্গ দিতে হবে।
আইএস হলো আধুনিক বিশ্বের একটি দুঃস্বপ্ন। এখানে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রী মোদি বিশ্বের আরো অনেকের মতো আমূল সংস্কারবাদ নির্মূল করার বিষয়ে কথা বলেছেন।
নিজ দেশ ভারতে, আইএসের আমূল সংস্কারবাদী চেতনা দ্বারা ভারতের মুসলমানদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে লেখক-রাজনীতিবিদরা কথা বলছেন। এখানে ‘আমরা’ এবং ‘তারা’ বলে দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে।
যখন মোদি ধর্ম এবং সন্ত্রাসকে আলাদা করে ফেলার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলছেন, তখন তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বা দক্ষ উপদেষ্টাদের কেউ নিশ্চয় তাঁকে নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদী চেতনা নিয়ে জানিয়েছেন। বিশ্বাসের নামে নিষ্পাপ দলিত সম্প্রদায়, উপজাতি এবং অন্য সংখ্যালঘুদের হত্যা করা হয়েছিল। লেখক-জাতীয়তাবাদীদের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। যারা প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছিল, তাদের হুমকি দিয়ে দমিয়ে রাখা হয়েছে। এই অসহিষ্ণুতা ও ধর্মান্ধতার যে সংস্কৃতি, যেটা হয়তে আগেও ছিল, কিন্তু এখন আইএসের চেয়ে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে; কারণ ভারতে আইএস এখনো তাদের অবস্থান তৈরি করতে পারেনি।
এ কারণে চেতন ভাগতের মতো একজন লেখক যখন অসহিষ্ণুতা নিয়ে চলমান আলাপকে বিদ্রূপ করে টুইট করেন, তখন নিজেদের খুব হতভাগা বলে মনে হয়। তিনি লেখেন, ‘ঠিক আছে, বীভৎস সন্ত্রাসী হামলার পর ইসলামকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেওয়া ভুল হয়েছে। তাহলে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার রেশ ধরে গোটা ভারতকে যে ‘অসহিষ্ণু’ বলা হচ্ছে; তার বেলায়?’
যেখানে আমি এবং দেশের অনেকেই একজন স্বস্বীকৃত বুদ্ধিজীবীর মন্তব্যকে সামগ্রিক ভারতের কণ্ঠস্বর বলে বিবেচনা করি না এবং তার গোঁড়া মন্তব্যকে তার স্খলন বলে মনে করি। এটা সামাজিক বিকৃত মানসিকতাকে উসকে দেয়। ফলে যারা দেশের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা নিয়ে কথা বলছিলেন তাদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে যায়। যেমন, এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বলতে পারি, বিজেপির এক বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা যখন দেশের মুসলমানদের পাকিস্তান চলে যেতে বললেন, তখন দেশের দুজন জনপ্রিয় সুপারস্টার আমির খান এবং শাহরুখ খানের উৎকণ্ঠা থেকে ছুড়ে দেওয়া মন্তব্যকে দেশের মানুষজন গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনল।
এই দুই অভিনেতা ভারতে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যা দেশের কট্টরপন্থীদের আরো পরিপুষ্ট করে তুলেছে। শাহরুখ এবং আমির এমন দুই পরিবারের সন্তান, যারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এরা দুজনেই বহুত্ববোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারপরও তাদের এখন অপদস্থ হতে হচ্ছে দেশের সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে নয়, মুসলমান নামের কারণে।
শাহরুখের স্বদেশ, চাক দে ইন্ডিয়া; আমিরের লগন, মঙ্গল পাণ্ডে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বক্তব্য নিয়ে নির্মিত ছবি। তারা যে ভারতকে বিশ্বাস করেছেন, সেই ভারতের চিত্র এই ছবিগুলোতে ফুটে তুলেছেন। সাধারণ মানুষের মতাদর্শকে বদলে দেওয়ার জন্য চলচ্চিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শাহরুখ খান নানা সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উচ্ছ্বাসভরে বলেছেন, তার ছেলেবেলায় গায়ত্রীমন্ত্র পাঠ করার কথা। আমির খান মোটামুটিভাবে একজন অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ভারতের অন্যান্য আইকন ও সুপারস্টারদের মতো খানরাও স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয় জাতিসত্তার উন্মেষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নানা জাতিসত্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সামন্ততান্ত্রিক, ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থা থেকে ভারত আধুনিক-প্রগতিশীল উদারচেতা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে।
আমির খান রামানাথ গোয়েঙ্কা অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে বলেছিলেন যে, দেশের এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে তার স্ত্রী তাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেন। এটা বলে আমির এ দেশের সন্তান হিসেবে দেশের ক্রমবর্ধমান জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করেছেন। আমরা কেন আমিরকে দেশদ্রোহী বলছি, যেখানে তার পুরস্কারজয়ী চলচ্চিত্র লগনকে প্রশংসা করেছি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সকল শ্রেণি-বর্ণের ভারতকে একত্রিত করে দেখানোর জন্যে। আমির তাঁর স্ত্রী কিরণের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর ছেলের নাম রেখেছেন তাঁর পিতামহ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নামে; যিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন।
আমাদের অবশ্যই আমিরকে সাধুবাদ জানাতে হবে, যখন তার বিরুদ্ধে কোর্টে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হলো এবং অসহিষ্ণুতা ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করে এফআইআর করা হলো, তখন আমির জাতিকে খুব আবেদনময়ী-আবেগঘন একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। আমির বলেছেন, ‘প্রথমেই আমি স্পষ্ট করে বলছি, আমি এবং আমার স্ত্রী কিরণ রাওয়ের দেশত্যাগ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আমাদের কখনোই দেশ ত্যাগ করার ইচ্ছে ছিল না বা ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোনো ইচ্ছে নেই।
যাঁরা আমাকে জাতীয়তাবাদবিরোধী হিসেবে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলছি, একজন ভারতীয় হিসেবে আমি গর্বিত এবং তাঁর জন্য আমার কারো কাছ থেকে অনুমতি বা প্রত্যয়ন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
আমি আমার উৎকণ্ঠা প্রকাশ করায় যাঁরা আমাকে গালিগালাজ করছেন তাঁদের বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনারাই আমার বক্তব্যের যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন।’ এরপর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রার্থনা’ কবিতাটি জুড়ে দিয়ে আমির খান বলেন, ‘আমি আমার স্টেটমেন্ট রবিঠাকুরের প্রার্থনা দিয়েই শেষ করতে চাই। তা ছাড়া এটি সত্যিকার অর্থেই আমারও প্রার্থনা।’ তারপর তিনি রবিঠাকুরের কবিতাটি তুলে ধরেন।
আমিরের সহকর্মী শাহরুখ খান ভারতের সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিত এবং ভারতে মোস্ট-লাভড্ খ্যাত অভিনেতা। শাহরুখ ভারতের ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় অসিষ্ণুতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অনুরূপভাবে অপদস্থ হয়েছেন। সাতবার নির্বাচিত এক বিজেপি এমপি তাঁকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদি বিশ্বব্যাপী আমূল সংস্কারবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ নিয়ে যথার্থই উদ্বিগ্ন। কিন্তু বৈশ্বিকভাবে ধেয়ে আসা সন্ত্রাসবাদের ভীতি দেখিয়ে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমিয়ে বা ছদ্মবেশে রাখা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলায় আক্রান্তদের উদ্দেশ্য করে মোমবাতিতে আলো দেন, তখন তিনি অবশ্যই নিজ দেশে এই দিওয়ালিতে সহিঞ্চুতার প্রদীপ জ্বালিয়ে দেশের সাম্প্রতিক অবস্থায় বিশাল অবদান রাখতে পারতেন।
আসুন নীরব না থেকে খানদের দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করার প্রতিবাদ করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মনে করে দেখুন, আপনি কী বলেছিলেন। লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরুনের পাশে দাঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘ভারত ছিল বুদ্ধ এবং গান্ধীর দেশ। ভারত এমন কিছু কখনই করবে না, যেটা মানুষের মৌলিক মূল্যবোধের অন্তরায় হয়।’ স্যার, এখনই সময় আমরা ওই সব মৌলিক মূল্যবোধের জন্য সংগ্রাম করে এমন একটা দেশ গড়ে তুলি যেটা বিশ্বে সাম্য ও ঐক্য স্থাপনের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।