বিজয়ের এই দিনে
ভুটানের স্বীকৃতি, হানাদারদের আত্মসমর্পণের আহ্বান
বাংলাদেশকে ভুটান ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বীকৃতি দিয়েছিল বলে অনেক নথিপত্র থেকে জানা যাচ্ছে।
স্বীকৃতি ভারত আগে দিল নাকি ভুটান, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত বিতর্ক চলছে। তবে এ বিতর্ক কতটা যুক্তির দাবিদার, তা বিবেকেরই বিষয়।
আমি গতকালকের আলোচনায়ও একই কথা বলতে চেয়েছিলাম। এটা মৌলিক কোনো বিতর্ক হতে পারে না।
তবে আমরা যুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণের দিকে লক্ষ করলে মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারি, আজকের দিনে তথা ৭ ডিসেম্বর ভুটান আর ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তিনি এ ভাষণটি ৮ ডিসেম্বর দিয়েছিলেন।
তাঁর বক্তব্যটা তুলে ধরা হলো, ‘ভারতের জনসাধারণ অনেক আগেই আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের অন্তরে। এখন তাদের সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছে।
বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির জনসাধারণের পক্ষে এ এক বিজয়। বিজয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, আর বিজয় তাদের মুক্তিবাহিনীর। ভারতের পর ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশকে। এর জন্য ভুটানের রাজা ও জনসাধারণের নিকট কৃতজ্ঞ।’
একটি ইংরেজি রূপও তুলে ধরা হলো :
Bhutan is the second country to accord recognition to the People’s Republic of Bangladesh. We are grateful to the King and the people of Bhutan for this noble act.
[Mujibnagar Government Documents 1971, Page: 419]
অনেক আলোচক তো ভুটানের স্বীকৃতিকে ৩ ডিসেম্বরই বলছেন। তাই বলে কি আমরা তাদের প্রতি গালি ছুড়ে দেব? নিশ্চয় না। এটা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বেমানান। কারণ, একটা দেশ তো হুট করে নতুন জন্ম নেওয়া কোনো রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় না। তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ আলোচনাও তো চলে। সে হিসেবে আমরা ভুটানের ব্যাপারটি আগেও ধরতে পারি। তবে শক্ত দলিলপত্রের দিকে তাকালে এ কথা বলা যায় যে, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দিক দিয়ে ভারত প্রথম আর ভুটান দ্বিতীয়।
অবশ্য ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টবগের এক বার্তা থেকেও তাঁর দেশকে দ্বিতীয় স্বীকৃতিদানকারী দেশ হিসেবে জানা যায়। একটা কথা তো সহজেই বলা যেতে পারে যে, তিনি যে বার্তাটি লিখেছিলেন তা তিনি তাঁর দেশের ইতিহাস না জেনে করেননি।
যা হোক, এদিন মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি নিয়ে বাংলার প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা উদ্বিগ্ন ছিলেন। ঠিক এ সময় ভুটান স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
এদিকে, যুদ্ধ-পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে জেনারেল নিয়াজি গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন রাওয়ালপিন্ডি হেডকোয়ার্টারে। রিপোর্টে বর্ণিত ছিল, সৈন্যরা দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, চাঁদপুর ও যশোরে প্রবল চাপের মুখে রয়েছে। গত ১৭ দিনে যেসব খণ্ড যুদ্ধ হয়েছে, তাতে জনবল ও সম্পদের বিচারে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে গেছে। রাজাকারদের অস্ত্রসহ সটকে পড়ার সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের নিজেদের ট্যাংক, ভারী কামান ও বিমান সমর্থন না থাকায় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে।
এ বার্তা পেয়ে পাকিস্তানি হেডকোয়ার্টার সৈন্যদের প্রতিরোধ ঘাঁটিতে সমবেত করার অনুমোদন দেয়।
রাত ১০টায় আকাশবাণী থেকে হিন্দি, উর্দু ও পশতু ভাষায় জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তোমাদের বাঁচার কোনো পথ নেই। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য তোমাদের ঘিরে রেখেছে। তোমরা যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছ, তারা তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। অনেক দেরি হওয়ার আগেই তোমরা আত্মসমর্পণ করো।’
নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষর করা হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সহযোগিতা চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক নিযুক্ত হন ভারতে ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
এদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে যায় এমন কোনো প্রস্তাব যদি জাতিসংঘ গ্রহণ করে, তাহলে ক্রেমলিন তা মেনে নেবে না।
নাস্তানাবুদ পাকিস্তানি বাহিনীকে রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফের প্রস্তাব করে, ভারত যেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে, তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে ফের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিলে এ প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়।
এদিকে যৌথ বাহিনীর যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের আকাশ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছত্রীসেনা নামানো শুরু করে। হানাদার বাহিনীর ঢাকায় আশ্রয় নেওয়ার সব পথ বন্ধ করতে রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোতে মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনারা অবস্থান নিতে সক্ষম হয়।
বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইল মুক্ত করে ঢাকার অভিমুখে রওনা হয়।
দিনব্যাপী সম্মুখ যুদ্ধের পর নড়াইল, কুড়িগ্রাম, ছাতক ও সুনামগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদাররা। আজকের এই দিনে জামালপুর, ময়মনসিংহ, মধুপুরও শত্রুমুক্ত হয়।
এদিকে গেরিলা যোদ্ধারা দলে দলে রাজধানীর আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিতে শুরু করেন। কারফিউর বাধা উপেক্ষা করে তাদের ঝটিকা হামলা চলতে থাকে। এতে সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে প্রতিরোধ করারও সাহস পায়নি। তবে তাদের দোসরদের নীলনকশা থেমে থাকেনি, যার বাহ্যিক রূপ আমরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেখতে পেয়েছি।