চাইলে নায়ক হতে পারেন মেয়র আনিসুল হক

Looks like you've blocked notifications!
লুৎফর রহমান হিমেল

ক.
আমি হতাশাবাদী নই। তারপরও যে কারো প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে প্রত্যাশার ঘরে ‘শূন্য’ ধরে রাখি। এতে দুটো লাভও হয়-

১. যখন দেখি সেই মানুষটি কথা রেখেছে, তখন সেটিকে বেসিকের ওপর ‘বোনাস’ হিসেবে দেখি এবং নিজে নিজেই ভীষণ খুশি হই। 

২. আর যখন দেখি, সেই মানুষটি কথা রাখেনি। আমি অখুশি হই না। কারণ আমি তো জানিই, সে কথা রাখবে না। এখানে লাভের লাভ হলো, হৃদয়ের ওপর হতাশার বাড়তি চাপ থেকে মুক্ত থাকা। 

নগরায়নের এই যুগে মানুষের মনেরও হয়তো নগরায়ন ঘটেছে। কথা না রাখা এখন অনেকের কাছে তাই একটি ফ্যাশন। অনেককেই দেখেছি, ফোনে বলছে, ‘দোস্ত, তুই পান্থপথ মোড়ে ৫মিনিট দাঁড়া; আমি ৩০মিনিটের মধ্যে আসতেছি।’ কিন্তু সে আর আসেনি। এমনকি এরপর পাঁচ বছর তার আর দেখা নেই। 

এ রকম অসংখ্য উদাহরণ এই ঢাকার নগরজীবনের ১৯ বছরে দেখেছি। অন্যদিকে কথা রাখারও অনেক উদারণও আছে। এই যেমন, সরকার যে তাদের কথামতো ২২দিন পর ফেসবুক শেষ পর্যন্ত খুলে দিল, এটাও কম কিসে!   

খ.
ফেসবুক বন্ধের দিনগুলোতে ভালো-খারাপ মিলিয়ে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। আমি একটি আশার কথা বলব। ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক তেজগাঁওয়ে রেলের জমি উদ্ধারে যে ভূমিকায় নেমেছেন, টিভি পর্দায় তা দেখে আমি ভীষণ আশাবাদী হয়েছি। অথচ এই আশাবাদ ওই ঘটনার আগেও আমার মধ্যে ছিল না। যেহেতু মেয়র নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিহীন হয়েছে, তাই মেয়রকে নিয়ে আমার কোনো প্রত্যাশাই ছিল না। কিন্তু অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ অভিযানের দৃশ্য টেলিভিশনে সরাসরি দেখে একজন সত্যিকারের জনপ্রতিনিধির প্রতিচ্ছবিই মনে হয়েছে। তিনি যেভাবে দখলদারদের বিরুদ্ধে হুংকার ছেড়ে বলেছেন, ‘মাস্তানি চলবে না।’ এই হুংকারে আন্তরিকতার সুর ছিল। এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ছিল। দুদক বা মানবাধিকার কমিশনের মতো এই হুংকার ছিল না। স্বাধীনতার এই চার দশক পরও আমরা শুধু মাস্তানি দেখে চলেছি, সেই মাস্তানির বিরুদ্ধে হুংকার দিতে দেখেছি খুব কম মানুষকেই।   
 
নির্বাচনের আগে আনিসুল হকের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল- পথচারীবান্ধব, দখল-যানজট-দূষণমুক্ত সবুজ নগর গঠন। ইতিমধ্যে তিনি দৃশ্যমান কিছু কাজও করে সফল হয়েছেন। তিনি নানা কাজে সাংবাদিকদের সহযোগিতা চেয়েছেন। 

আমি একজন ভুক্তভোগী নগরবাসী হিসেবে মেয়র সকাশে আরো যোগ করে বলতে চাই : 

এই নগর এখনো পথচারীবান্ধব হয়নি। ফুটপাতগুলো খালি করুন। যানজট অনেক কমে যাবে। পথচারীরাও ফিরে পাবে তাদের স্বস্তি। ফুটপাতে দখলবাজি করে অবৈধ অস্থায়ী দোকান থেকে কে বা কারা চাঁদা তুলছে, আপনি তা ভালো করেই জানেন। এদের উচ্ছেদ করুন, ছাড় দেবেন না। পথচারীদের ফুটপাত ফিরিয়ে দিন। 

নগরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাসসার্ভিস বাধ্যতামূলক করুন। একেকটি বাসে ৩০ জন শিক্ষার্থী বহন করা হয়। অথচ এই ৩০ জনকে বহন করতে ৩০টি প্রাইভেট কার বাসা থেকে স্কুলে যাতায়াত করে। নগরে এ রকম ১৪ হাজারেরও বেশি প্রাইভেট কার রয়েছে শিক্ষার্থীদের আনা নেওয়ার জন্য। এ ক্ষেত্রে স্কুল বাসসার্ভিস হলে যানজট কমে যাবে অর্ধেক। দুঃখের বিষয়, এ সম্পর্কিত একটি উদ্যোগ বাস্তবায়নে ২০০৯ সালে ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ড (ডিটিসিবি) অনেক দূর এগিয়ে গেলেও পরে সেটি মুখ থুবড়ে পড়ে। সেটি আবার ফিরিয়ে আনুন।
 
ট্যাক্সি ক্যাব বা সিএনজি নয়; বাস সার্ভিস বাড়ান। সাথে বাসমালিক ও পুলিশের হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা নিন। রাস্তায় গাড়ি নামালেই দলীয় ক্যাডারদের মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয় নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে। এ কারণে রাজধানীর সড়কগুলোতে অনুমোদিত ৯৮টি পরিবহন কোম্পানির মধ্যে ২৪টি কোম্পানিই তাদের সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিন।

আমি খুবই আশাবাদী একজন মানুষ। সবকিছুর শেষটা দেখতে আমি ভালোবাসি। ঢাকা শহরের বর্তমান যে সমস্যাগুলো আছে, তার সবকিছুই কি আসলেই বড় কোনো সমস্যা? আন্তরিকতা থাকলে এ সমস্যা দূর করা কোনো ব্যাপারই নয়। আমার তো মনে হয় প্রায় দুই কোটি মানুষ নিয়ে বসবাস করা এই শহরে বড়দাগের সমস্যা তো একটাই। যানজট। ঢাকা শহরের রাস্তাগুলোতে বর্তমানে যে পরিমাণে যানবাহন চলাচল করে, তা কি কখনো রাস্তা নির্মাণ করে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব? মনে হয় না। রাস্তা নির্মাণ করলে বড় জোর যা হবে গাড়িগুলো নতুন কিছু রাস্তা পাবে। কিন্তু ১-২ বছর পর, ২০ বছর পর বা ৩০ বছর পর? আপনি কতবার রাস্তা নির্মাণ করবেন? এরচেয়ে এর ব্যবস্থাপনাটাই বড় বিষয়।

আপনি নিজে ঘুরে ঘুরে নগরের ৭০টি জায়গা চিহ্নিত করেছেন যেখানে ময়লা-বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে ফেলা হচ্ছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এরমধ্যে ১৪টি আপনার ডিএনসিসির, বাকিগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের। এসব জায়গায় বর্জ্য স্টেশন নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিন। নগর বদলে যাবে।

একইসাথে অবৈধ দখলে যাওয়া খাল, সরকারি জমি, অবৈধ বিলবোর্ড, অপরিকল্পিত কাঁচাবাজার উচ্ছেদে অভিযান অব্যাহত রাখুন। সহযোগিতা লাগলে শুধু একটি ডাক দিবেন, লাঠি-বাঁশি নিয়ে লাখো ঢাকাবাসী আপনার অভিযানকে নির্বিঘ্ন করতে চলে আসবে। এই শহরকে বাসযোগ্য করতেই হবে। আমি বড় আশাবাদী মানুষ। আপনার ওপর প্রত্যাশার বাজি ধরলাম; যদি জিতে যাই সেটা বোনাস। আর যদি না জিতি, নতুন করে হয়তো আবার আশায় বসতি গড়ব। আর হ্যাঁ, ক্ষমতা গ্রহণের পর যতটুকু করেছেন তার জন্য বিলম্বিত ধন্যবাদ। প্রতিশ্রুতি মতো বাকিটুকু করতে পারলে টুপিখোলা অভিনন্দন পাবেন। 

আপনি আপনার বর্ণাঢ্য জীবনে একজন উদ্যোক্তা, টেলিভিশন উপস্থাপক এবং বর্তমানে ঢাকার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চৌকশ উপস্থাপনা ও সুন্দর মুখশ্রীর কারণে শোবিজ জগতে আপনি স্বকীয় জায়গা করে নিয়েছিলেন। কিন্তু নায়কের অভিনয়টা করা হয়নি। এখন সত্যিকারের নায়ক হওয়ার উপলক্ষটা এসেছে আপনার সামনে। 

লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।