বিজয়ের এই দিনে
জাতিসংঘের অনুরোধে যৌথ বাহিনীর বিমান হামলা সাময়িক বন্ধ থাকে
আজ ১১ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোরে এক জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সিদ্ধান্তগুলো হলো :
১. বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এ ট্রাইব্যুনাল নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধ-বন্দিদের বিচার করবে।
২. ২৫ মার্চের আগে যাঁরা জমি-দোকানের মালিক ছিলেন, তাঁদের সব সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
৩. সব নাগরিকের সমঅধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে।
৪. জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামী ইসলাম—এ চারটি দল নিষিদ্ধ করা হবে।
এসব সিদ্ধান্তের পাশাপাশি তাঁরা যশোর সার্কিট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করা হবে, যা পাকিস্তান ২৪ বছরেও করতে পারেনি।’
এদিন ঢাকায় যৌথ বাহিনীর বিমান হামলা সাময়িক বন্ধ থাকে, যাতে করে বিদেশি নাগরিকরা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে পারেন। জাতিসংঘের অনুরোধে মূলত এটি করা হয়েছিল। আর এর পেছনে ছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী কর্তৃক জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রেরিত জরুরি বার্তা।
এদিকে মেজর জেনারেল রাও ফারমান আলী খানের মাধ্যমে গভর্নর ডা. মালিক ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধিপল মার্ক হেনরির কাছে শর্ত সাপেক্ষে আত্মসমর্পণের এক প্রস্তাব পেশ করেন।
এ প্রস্তাবটির ব্যাপারে জানা যায় সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংর্থের প্রতিবেদন থেকে। ক্লেয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই প্রস্তাবে পাঁচটি শর্ত ছিল। শর্তগুলো হলো :
১. ভারতীয় যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে পাকিস্তানি বাহিনী।
২. বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারা কোনো লিখিত চুক্তি করবে না।
৩. পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে ফেরত দিতে হবে।
৪. পাকিস্তানি সেনাদের যেতে দিতে হবে।
৫. সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে।
কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে যুদ্ধে সহায়তা করার অনুরোধ করেন। তবে নিক্সন এ ব্যাপারে নিশ্চুপ ছিলেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য ভারত-পাকিস্তানের প্রতি জোর দাবি জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এ ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের তৎকালীন মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার বলেন, ‘জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক।’
অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘১২ ডিসেম্বর দুপুরের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। নচেৎ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
একাত্তরের আজকের দিনে জামালপুর, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, চণ্ডীপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফুলছড়িহাট, নরসিংদী, বাহাদুরবাদঘাটসহ মুক্ত হয় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। যৌথ বাহিনীর ছয় দিনব্যাপী অবরোধ ও প্রচণ্ড যুদ্ধের পর এদিন ভোরে মুক্ত হয় জামালপুর।
এ সময় জামালপুর গ্যারিসনে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ছয়জন অফিসার ও ৫২২ সেনা যৌথ বাহিনীর আছে আত্মসমর্পণ করে। এ ছাড়া শত্রুপক্ষের ২১২ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হয়।
মিত্রবাহিনী হিলি সীমান্তে ব্যাপক প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। সন্ধ্যার দিকে যৌথ বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় হানাদারদের ঘাঁটির ওপর প্রবল হামলা চালায়। সারা রাত ধরে এ আক্রমণ চলে। মিত্রবাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়ে হানাদার বাহিনী ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করে। এদিকে সপ্তম নৌবহরের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগর অভিমুখে চলতে থাকে।