ক্ষমতাহীন জনপ্রতিনিধির ক্ষমতাহীন সরকার

Looks like you've blocked notifications!

মানিকগঞ্জ পৌরসভার সুউচ্চ ভবন, যার লাগোয়া বিশাল আয়োজনের ব্যাডমিন্টন কোর্ট, খেলার বিলাসী আয়োজন। তা থেকে দাসোরা মৌজায় ভেঙে পড়া, উঁচু-নিচু গর্তের রাস্তা ও গ্রামটির দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। সেখানে পৌর মেয়র প্রার্থী মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ কেমন পৌরসভা? পৌরসেবা?’ আমার প্রশ্নে টেলিভিশনের মাইকের সামনে ততোধিক আগ্রহ নিয়ে উল্টো তিনিই আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তাহলে আপনিই বলুন, কী অবস্থা। এ কারণেই তো মাঠে নেমেছি।’

দলের প্রার্থী হতে না পেরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বলেই হয়তো আমার প্রশ্নে তিনি খুশি হয়েছেন। বললেন, ‘আপনি একটু ঘুরে দেখুন না। পুরো পৌরসভার পয়োনিষ্কাশন, রাস্তাঘাট আর খাবার পানির ব্যবস্থা নিয়ে পৌরবাসীর নাজেহাল অবস্থার খবর পাবেন।’

কারো অনুরোধে নয়, নিজের পেশাগত দায়িত্বেই পড়ে, তাই শহরটা ঘুরে দেখা। শহরের মধ্যে প্রকৃতির দেওয়া খালটি গলাটিপে মেরে ফেলা হয়েছে। যেহেতু তাকে উঠিয়ে নিয়ে কোথাও ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়, তাই খালটি অগোছালো শহরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, এক নাগরিকের পরামর্শে তাকে খুঁজে পেয়ে শুধু কষ্টই বেড়ে চলে।

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে যখন নতুন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ, সে বছরই মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম মানিকগঞ্জ পৌরসভারও। অর্থাৎ দেশের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই শহুরে সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল মানিকগঞ্জে। পাশের জেলা রাজধানী ঢাকার সঙ্গে, দেশের কত কত উন্নয়নের সঙ্গে একদম মিল নেই মানিকগঞ্জ পৌরসভার।

টানা ৩৮ বছর ধরে পৌর মেয়র ছিলেন এবারের আওয়ামী লীগ প্রার্থী রমজান আলী। এ নিয়ে একাধিক প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিতে অস্বস্তিতে পড়ে যান। গুছিয়ে আর বলতেই পারলেন না। তার অসম্পূর্ণ কাজ ফেলে রাখতে চান না বলে ফের মেয়র হতে চাইছেন তিনি।  

২০০০ সালের ২৬ জুলাই জন্ম দেশের আরেক পৌরসভার। নাম গোয়ালন্দ পৌরসভা। আয়তন ৪.৮৫ কিলোমিটার। মোট ১৪ কিলোমিটার পাকা সড়কের এক পৌরসভা। এখানকার পৌরপিতা শেখ মো. নিজাম ২৩ বছরে বয়সেই নির্বাচিত মেয়র হয়ে যান। তার পর থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও মেয়র হিসেবে তিনিই জিতেছেন, সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

বাস এত দ্রুত চলে যায় যে ঢাকা-রাজবাড়ী মহাসড়কে গোয়ালন্দ পৌরসভা লেখাটি ছাড়া বোঝার কারণ নেই এটিও একটি পৌরসভা। তবে উপজেলা অফিসটি চোখে পড়ে। কথা হলো পৌরপিতা মো. নিজাম ও শুরু থেকেই বিজয়ী কাউন্সিলর কোমল সাহার সঙ্গে।

মূল সড়ক থেকে গিয়ে আবারো স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ও সদ্য সাবেক মেয়র মো. নিজামের সঙ্গে যেখানে কথা বললাম সেটা আক্ষরিক অর্থেই অজপাড়াগাঁও। কুমড়াকান্দি গ্রামের ফকিরবাড়ী। পেছনের বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ। মাটির পথ হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো, ঠিক পাশেই তার রাজবাড়ী পৌরসভা, নিজে একটি উপজেলা হিসেবেও কতটুকু দাঁড়িয়েছে গোয়ালন্দ, তার পরও এটাকে জোর করে কেন পৌরসভা করতে হবে?

যে বাড়িতে গেলাম, সেখানে ভাগ্যক্রমে মিলে গেলেন বিএনপির মেয়র প্রার্থীও। তবে নিজামের কাছে কী প্রশ্ন করব তা-ই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবুও প্রশ্ন, ১৪ বছর ধরে আপনি এখানকার মেয়র। কী করেছেন শহরের আর কী করবেন? এ প্রশ্নের গৎবাঁধা উত্তর শোনার পর প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা স্থানীয় সরকারের কী সুযোগ দেয় এসব পৌরসভা?’ সাহসী তরুণ বললেন, ‘স্থানীয় সরকারের ওপর কেন্দ্রীয় সরকার, মানে এমপি সাহেব যা বলেন তাই যে হতে হয়, এটা সবাই জানেন।’

সত্যি কথা বললে, ১৪ বছর ধরে স্থানীয় সরকারের এই মেয়র তার স্বাধীন সত্তা হারিয়েছেন শুধু। দিন দিন তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির স্বপ্ন ফিকে হতে দেখেছেন তিনি। দুঃখের কথা জানালেন পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৪ বছর ধরে বিজয়ী কাউন্সিলর কোমল সাহা।

তাঁর কথা, এলজিইডি তাঁদের প্রশিক্ষণে যা বলে, ঢাকায় নিয়ে প্রথম প্রথম যেসব কথা শোনানো হয়েছিল, বাস্তবে তার কোনো মিল নেই। এই ১৪ বছরে কি বয়স্ক-ভাতা, কুকুরে কামড় দিলে তার প্রতিষেধক ওষুধ, মশা তাড়ানোর মেশিন কোনো কিছুতেই যা বলেছিলেন, সেই সেবা দিতে পারেননি।

মাইক্রোফোন পেয়ে কোমল সাহার গলা ধরে আসে। বলতে থাকেন, ‘জানেন, পৌরসেবার অন্যতম উপাদান বয়স্ক-ভাতা দেওয়া। সেটা থেকেও বঞ্চিত হয়েছি।’ তাহলে নির্বাচনের আগে এত কথা বলেন কীভাবে? বললেন, ‘এই খ ও গ শ্রেণির যত পৌরসভা আছে, সেখানে কি মেয়র, কি কাউন্সিলর যা প্রতিশ্রুতি দেন, বাস্তবে তা করার ক্ষমতা তাঁদের নেই।’

ক্যামেরার সামনে কোমল সাহা বলতে থাকেন। তাঁর দাবি, যত ক্ষমতা, যত অধিকার শুনেছিলাম, ১৪ বছরে তার ১০ ভাগও হতে দেখিনি। বলা প্রয়োজন এবারও কাউন্সিলর পদে লড়ছেন তিনি। এলাকায় সৌম্য, সজ্জন ব্যক্তি বলে পরিচিতি আছে তাঁর। কথা বলার সময় গোয়ালন্দ রেলস্টেশনে ভিড় করা মানুষগুলো মাথা নেড়েই বুঝতে পারছিলেন পৌরসভা, পৌরসেবা আসলে, ভেতরে ভেতরে কতটা ফাঁকা।

রাজবাড়ী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও পরে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে জনপ্রতিনিধির আচরণ এখন এক ধরনের প্রতারণার মতো হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁদের করারও কিছু নেই। স্থানীয় সরকারের কনসেপ্টটাই এখন প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। একে বাঁচাতে হবে।’

দেশের তিন শ্রেণির ৩২৩ পৌরসভার এই হাল নিয়ে দুজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান স্পষ্ট করে বললেন, ‘এই দেশে স্থানীয় সরকারের কোনো স্বাধীন সত্তা নেই।’

চমৎকৃত হওয়ার মতো কথা। প্রান্তিকের পৌর মেয়র ও কাউন্সিলর যা বললেন, আকবর আলির কথার সুর হুবহু এক। সাবেক উপদেষ্টার দাবি, এ দেশের সব সরকার পালাক্রমে স্থানীয় সরকারের মূল ভাবনা থেকে দূরে সরে এসে এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের থাবা মেরেছে। রাজনীতির পরিবর্তন না হলে এসব ভোটাভুটির কোনো মূল্য নেই, শুধুই অর্থ খরচ আর সহিংসতা।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের কণ্ঠেও প্রচণ্ড ক্ষোভ। তাঁর অনুসন্ধান, ‘অবাক করা বিষয় হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ বা পৌরসভা একই এলাকার মধ্যে হলেও কারো সঙ্গে কারো কোনো সমন্বয় নেই। নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা জানেন না, নির্বাচিত হওয়ার পর তার ভূমিকা কী হবে। অথবা আইন বা বিধানে অনেক কিছু লেখা থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় সাংসদের বাইরে গিয়ে করার তাঁর কিছুই নেই। এভাবে রাজনৈতিক স্টান্ট নিতে পাড়া-মহল্লার মতো বেড়েছে পৌরসভার সংখ্যা, কমেছে পৌরসেবার মান।’

হাটে-মাঠে-ঘাটে জনপ্রতিনিধি, আর এমন প্রশাসনের মধ্য থেকে শীর্ষে আসা আমলা আর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে একটা বিষয় স্পষ্ট। যে উপজেলার জন্য চেয়ারম্যান নির্বাচন হয়, সেই চেয়ারম্যান ক্ষমতাহীন, রাজপথে তাঁকে বছরের পর বছর ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার দাবিতে বিফল আন্দোলন করে যেতে হয়।

লেখক : সাংবাদিক, এটিএন নিউজ