কট্টরপন্থীদের লড়াই এবং একজন গোবেচারার কর্তব্য

Looks like you've blocked notifications!
যায়নুদ্দিন সানী

মোটাদাগে ব্লগ দুনিয়ায় দুটি গ্রুপ আছে। নাস্তিকবাদী আর আস্তিকবাদী। নাস্তিকবাদী গ্রুপের আবার কিছু সাব-গ্রুপ আছে। কেউ অতি নাস্তিক, কেউ কম নাস্তিক। কেউ ধর্ম বিশ্বাস না করলেও ধর্মকে কটাক্ষ করতে রাজি নন। মৌলবাদী গ্রুপেরও একই অবস্থা। কেউ ধর্মের জন্য ‘কল্লা’ ফালাইতে উৎসাহী। এদেরকে অনেকেই ‘মৌলবাদী’ কিংবা ‘জঙ্গি’ বলেন। কেউ ধর্ম অবমাননাকারীকে কেবল ‘ব্লক’ কিংবা ‘আনফ্রেন্ড’ করেই ক্ষান্ত দেন। আবার অনেকে আছেন, তাঁরা অখুশি হন কিন্তু সেই পর্যন্তই। এই নাস্তিকদের অন্য অনেক লেখা ভালোলাগে বিধায় তাঁরা সেসব লেখকের অনেক লেখাই পড়েন। 

অভিজিৎ রায়ের হত্যার পরপরই শুরু হয়ে যায় গৎবাঁধা কিছু প্রতিক্রিয়া। নাস্তিক গ্রুপ ফেসবুক, ব্লগসহ পুরো সোশ্যাল মিডিয়ায় ধিক্কারের রব তোলে। কট্টর নাস্তিক গ্রুপের তরফ থেকে আরো জানানো হয়, এই হত্যাযজ্ঞ মৌলবাদী শক্তিরাই করেছে। কারণ মৌলবাদী গ্রুপ থেকে প্রায়শই অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দেওয়া হতো, ফলে দুইয়ে দুইয়ে চার। কেউ কেউ আবার এই দায়ী করা ব্যাপারটাকে অনুৎসাহিত করেন। তাঁরা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে বারণ করেন। অনুসন্ধান বা হত্যাকারী খোঁজাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ছেড়ে দিয়ে বরং বিচার চাইবার দাবিটি জোরালোভাবে উচ্চারণ করতে বলেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আরো কিছু ব্যাপার হয়। কট্টরপন্থী নাস্তিক গ্রুপটি এই মৃত্যুটি সম্পর্কে কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করে। কঠোর ভাষায় এর নিন্দা জানাতে হবে এবং কোনোভাবেই তাঁর লেখালেখি ব্যাপারটাকে এই মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত করা যাবে না। আর করলেও বলতে হবে, তিনি ছিলেন বিজ্ঞান লেখক। বেছে বেছে তার লেখাগুলো কিংবা স্ট্যাটাস থেকে সেসব খুঁজে বের করা হলো, যেখানে ধর্মকে তিনি কটাক্ষ করেননি।

এবং আরো জানান দেওয়া হলো, এর অন্যথা হলে, এই নিয়মের ব্যতিক্রম করে কোনো রকম স্ট্যাটাস দিলে তাদেরকে এসব নাস্তিক গ্রুপ ‘আনফ্রেন্ড’ করবে। 

ব্যাপারটার উল্টো ভার্সনও আছে। আস্তিকবাদীদের ভেতর কট্টর গ্রুপটা বেশ গর্বের সাথেই ঘোষণা করছে, ‘এই হত্যা জায়েজ’। কেউ কেউ আছেন, ‘হত্যা করা ঠিক হয়নি’ টাইপ। এদেরকে ঈশ্বরই শাস্তি দিতেন বা ঈশ্বরই একসময় সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতেন জাতীয় কথা বলার চেষ্টা করছেন। আর কিছু আছেন, ‘বললেই বা কি, না শুনলেই হলো। কিংবা ওদের লেখা না পড়লেই হলো’।

বলাই বাহুল্য, দুটি গ্রুপেরই নমনীয় মানুষের সংখ্যা বেশি এবং তাদের কোনো ‘ভয়েস’ নেই। যতটুকু যা চিৎকার চেঁচামেচি, তা করছে এই কট্টর গ্রুপটা। এক গ্রুপ ধর্মের গুষ্টি উদ্ধার করে, তো অন্য গ্রুপ এই নাস্তিকদের ‘কল্লা’ ফালায়।

কোনো নাস্তিকবাদী লেখকের কোনো স্ট্যাটাসে গেলে দেখা যাবে, কট্টর আস্তিক গ্রুপ কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ‘চ’ বর্গীয় গালিগালাজ থেকে শুরু করে ‘দেখে নেব’ টাইপ কথাবার্তায় পূর্ণ। এই গালিগালাজ তার ধর্মকে সবার সামনে সম্মানের আসন দিচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে তার কোনো আত্মগ্লানি নেই। ‘আমার ধর্মকে গালি দেবে, আর আমি ছেড়ে দেব?’ কমবেশি সব গালিবাজদের এই একখানাই যুক্তি। সমস্যা হচ্ছে, গালি দিয়ে ধর্মের কী লাভ হলো, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তার মনে জাগেও না কিংবা তা ভাববার কোনো বিষয়ও সে মনে করে না। তাঁর ধর্ম সবার কাছে ছোট হয় হোক, ধর্মকে কটাক্ষ করা মানুষটিকে গালি দিতেই হবে।

ব্যাপারটা ঠিক একতরফা না। উল্টোটাও ঘটছে। ‘ধর্মকে কটাক্ষ করার দরকার কি?’ এই কথা বলেছেন কি, কট্টর নাস্তিকবাদীরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। ‘ব্যাটা মৌলবাদী।‘ আর কিছুক্ষণ পরে বলবে, ‘হেফাজতি’ পরের ধাপে হবেন রাজাকার কিংবা জামায়াত। এরপরে চলে আসবে ‘চেতনা’। তবে যদি জানা থাকে আপনি আওয়ামী ধারার লোক, তবে কটাক্ষ করা হবে ‘মদিনা সনদ’ দিয়ে। 

দুইদিকের কট্টরপন্থীদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। সংখ্যায় বেশি হলেও এই গ্রুপটির মনে খুব বেশি কাজ করে, ‘পাছে লোকে কিছু বলে’। ঈশ্বরে বিশ্বাস করি বললে একজন কট্টর নাস্তিকবাদী বলতে পারে, ‘ছি ছি’ আর না মানলে আস্তিকবাদী কট্টর বন্ধুটি চোখ কপালে তুলে বলবে, ‘কী বলছিস তুই এসব?’। নিজের মতো অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার এই মানসিকতায় দুই গ্রুপের কেউই কম যায় না। ‘আমার কথাটাই ঠিক’ এই অবস্থা থেকে দুই গ্রুপের কেউই বেরিয়ে আস্তে রাজি না। একজন দিচ্ছেন বিজ্ঞানের দোহাই, আরেকজন দিচ্ছেন ধর্মের দোহাই। তবে দুই গ্রুপই একই কথা বলছে, ‘হয় তুমি আমার দলে, আর নয়তো আমার শত্রুর দলে।’ ধর্মকে অসম্মান করেন না, আবার বিজ্ঞানকেও ভালোবাসেন, এই গ্রুপের হয়ে গেছে সমস্যা। আর কটাক্ষের ভয়ে বেচারা চুপটি মেরে থাকে।

সেদিন ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’-খ্যাত লেখক ড্যান ব্রাউনের একটি সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। কট্টর আস্তিকবাদীদের কাছ থেকে এই লেখককেও বেশ উচ্চমার্গের গালিগালাজ শুনতে হয়েছে। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কেন একজন মানুষ গালি দেয়’। তাঁর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘কারণ, প্রতিবাদ জানাবার কোনো সৃজনশীল উপায় তাঁদের জানা নেই।‘ এরপরে যখন তাঁর সম্পর্কে করা বেশ কিছু বিজ্ঞজনের সমালোচনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, তখন তিনি বললেন, যদি ভালোলাগাগুলো কেবল মনে রাখি, তবে অহংকারী হয়ে যাব। আর সমালোচনাগুলো শুনি, তবে লিখতেই পারব না। তাই সবগুলোই শুনি। কিন্তু আমি নিজের মতোই চলি।

ঈশ্বর আছে না নাই, এই বিতর্ক হয়তো কোনোদিনই থামবে না। আস্তিকরাও প্রমাণ করতে পারবেন না, ‘ঈশ্বর আছেন’ আর অন্যদিকে নাস্তিকরাও প্রমাণ করতে পারবেন না, ‘ঈশ্বর নেই’। আর তাঁরা কী ভাববেন, বা বলবেন, এই ভেবে নিজের কথা বলতে পিছপা হয়েই বা কী করবেন? তাই বিজ্ঞানকে ভালোবাসবেন না ধর্মকে, তা একান্তই আপনার ব্যাপার। ঈশ্বর মানতে চান মানুন, বিজ্ঞান উপভোগ করতে চান করুন, আর দুটোই মানতে চাইলে—দুটোই মানুন।

পড়ুন, জানুন এবং নিজের বিচার-বুদ্ধিমতো চলুন। কে কী বলল ভেবে চলতে চাইলে, চলতেই পারবেন না।

যায়নুদ্দিন সানী : লেখক ও সহকারী অধ্যাপক, রংপুর মেডিকেল কলেজ।