ছাত্রলীগের পথচলার ৬৮ বছর

Looks like you've blocked notifications!
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ ৪ জানুয়ারি। এ উপলক্ষে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজিত সমাবেশে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ছবি : ফোকাস বাংলা

দেশ বিভাগের দগদগে ক্ষত তখনো শুকোয়নি। চারদিকে দাঙ্গার দামামা বাজছে। সে এক নৃশংসতম সময়। সদ্য স্বাধীন ছয় কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যা বিশিষ্ট পাকিস্তানের চার কোটি ৪০ লাখ মানুষই বাংলাভাষী। তা সত্ত্বেও সরকার, প্রশাসন, সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় ১৯৪৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশসহ প্রচারমাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবল উর্দু ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়।

দূরদর্শী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখনই বুঝতে পেরেছিলেন সংগ্রাম করে যে স্বাধীন পাকিস্তান অর্জিত হয়েছে, তার কোনো সুফলই বাঙালি  জাতি ভোগ করতে পারবে না। বরং বাঙালিরা নতুন শোষণের যাঁতাকলে পড়বে। তাঁর ভাষায় এটা ছিল, ‘এক শকুনির হাত থেকে অন্য শকুনির হাতবদল মাত্র’। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পরবর্তীকালে তাই ঘটেছিল।

শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন শোষণের কালো হাত ভাঙার একমাত্র হাতিয়ার হতে পারে ছাত্রসমাজ। তাই তাঁর সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে যাত্রা শুরু করে তৎকালীন পাকিস্তান ছাত্রলীগ।

সংগঠনটির প্রথম আহ্বায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। পরে সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম শুরু করলে সভাপতি মনোনীত হন দবিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন খালেক নেওয়াজ খান।

তারপরের পথচলা সংগ্রাম, প্রতিবাদ, প্রতিরোধে আরো গৌরবান্বিত। জন্মের পরপরই রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কুচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। বাংলাকে জাতীয় ভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চে ডাকা ধর্মঘটের পুরোভাগে ছিল ছাত্রলীগ। ওই দিন ধর্মঘটের পিকেটিং থেকে গ্রেফতার হন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ছাড়া পুলিশের লাঠিপেটা ও নির্যাতনের শিকার হন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও আন্দোলন জোরদার করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের নেপথ্যের কারিগরও ছিলেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ১৯৫৬ সালের বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়, ১৯৫৭ সালের শিক্ষক ধর্মঘট এবং ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল সংগঠনটি।

বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা’ আন্দোলনে রাজপথের প্রথম সারিতে অবস্থান ছিল ছাত্রলীগের। এ সময় নিজেদের দলীয় ১১ দফার মাধ্যমে ছাত্রসমাজের রক্তে ঘূর্ণিগতি সঞ্চার করে ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে ছাত্র-গণ আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে মুক্তির সনদ ছয় দফাকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংগ্রামে এক দফার গণভোটে রূপায়িত হয়।

যে গোটা ষাটের দশককে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির সোনালি সময় বলা হয়, তা বলতে গেলে অনেকাংশে ছাত্রলীগের রাজনীতিরই ইতিহাস। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের মূল্যে লাল-সবুজের যে পতাকা আমরা পেয়েছি, তাতে ছাত্রলীগের ১৭ হাজার নেতাকর্মী জীবন বিসর্জন দিয়েছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশে বহু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ছাত্রলীগ রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ১০ দফা তৈরিতে নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। তখন শিক্ষার অধিকার প্রসারে শামসুল হক ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কমিশনে রিপোর্ট তৈরিতে ছাত্রসমাজের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ।

১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে ছাত্রলীগ ছিল আপসহীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর মৌলবাদী হামলার প্রতিবাদে রাজপথে ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছাত্রলীগের গড়ে তোলা দুর্বার আন্দোলনের কারণে স্বৈরাচার এরশাদের পতন তরান্বিত হয়।

১/১১-এর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে সামরিক শাসনের সময়ও মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসনে পতনের হাত থেকে রক্ষায় ভূমিকা রাখে ছাত্রলীগ। ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ক্ষমতারোহণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সংগঠনটি।

তবে মহাজোট সরকার ক্ষমতারোহণের পর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের খুন-খারাবি, হল দখল, সাংগঠনিক কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষক লাঞ্ছনা, যৌন হয়রানিসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় সুধীমহলে প্রশ্ন ওঠে, ‘এই কি তবে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্রলীগ?’

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিরোধী জোটের হরতাল চলাকালে পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ নামের এক দর্জি দোকানিকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করার পর এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে না পেয়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক পদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগের  সমালোচনা করতে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও।

অনেক সমালোচনা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে অছাত্র নেতৃত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রচেষ্টায় সাধুবাদ পেয়েছে বাংলাদেশের প্রাচীনতম এ ছাত্র সংগঠনটি। পরিবর্তন যদিও একদিনে সম্ভব নয়, তথাপি ছাত্রলীগে পরিবর্তন বাংলাদেশের গোটা ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ সংগঠনের আমূল পরিবর্তনের জন্য সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে মূল সংগঠন আওয়ামী লীগকেই।

জন্মদিনে ছাত্রলীগের উচিত সাধারণ ছাত্ররা যেন ভালোবেসে এ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, মেধাবীরা যেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার জন্য সর্বাগ্রে এ সংগঠনকেই বেছে নেয়-সংগঠনে সে পরিবেশ ফিরিয়ে আনার শপথ গ্রহণ করা।

এ সংগঠনের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু তা সংগঠনের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারলেই সফল হবে আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। শুভ জন্মদিন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

হাসান আল মাহমুদ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।